ধারদেনায় চলছে সংসার, খাদ্যতালিকা থেকে বাদ মাছ-মাংস

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ময়মনসিংহ
প্রকাশিত: ০৯:৩০ পিএম, ০৫ মার্চ ২০২৩

পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। লাগাম ধরার যেন নেই কেউ। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষ। রোজগারের চেয়ে তাদের খরচ বেশি। তাই সংসারের চাহিদা মেটাতে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। এরপরেও কুলিয়ে উঠতে না পেরে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হচ্ছে মাছ ও মাংস।

রোববার (৫ মার্চ) দিনব্যাপী ময়মনসিংহ নগরীর প্রধান কাঁচাবাজার ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে।

সকালে নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ মোড় থেকে অটোরিকশায় গাঙ্গিনারপাড় যাওয়ার পথে কথা হয় চালক সাইদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের চর ঈশ্বরদিয়া এলাকার বাসিন্দা। দুই ছেলে, এক মেয়েসহ পাঁচজনের সংসার।

সাইদুল বলেন, দুইদিন আগেও অটোরিকশার দৈনিক জমা ছিল ৫০০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৫০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে টাকা বাড়িয়েছে মালিকরা। কিন্তু রোজগার বাড়েনি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০ টাকা রোজগার করা যায়।

তিনি বলেন, এর মাঝে ৫৫০ টাকা মালিককে জমা দিলে ৫০০ টাকা থাকে। এই ৫০০ টাকা দিয়ে দুইদিন চলতে হয়। আজ সারাদিন রিকশা চালাতে পারলেও আগামীকাল বাড়িতে বসে থাকতে হবে। কারণ, সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী একদিন লাল রঙের অটোরিকশা চলবে ও অন্যদিন নীল রঙের রিকশা চলবে।

jagonews24

সাইদুল আরও বলেন, আমার সংসারে দুইদিনে পাঁচ কেজি চাল লাগে, যার দাম ৩২০ টাকা। বাকি ১৮০ টাকা দিয়ে দুইদিনের সবজি, তেল, আলু ও ডালের দামই হয় না। প্রতিবেশীর কাছে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হয়। মাসের পর মাস ডাল ও শুকটি খেয়ে দিন পার করছি। মাছ-মাংস ছেলে মেয়েদের কিনে খওয়ানোর সামর্থ্য হয় না। তাই, খাওয়াতেও পারি না।

দুপুরে নগরীর মেছুয়াবাজারে ঘুরে কথা হয় মুরগি বিক্রেতা মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি মুরগির দাম কেজিতে ৮০ টাকা বেড়ে ৫৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এদিকে, ব্রয়লার, সোনালী, সাদা কক, লেয়ার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা। সোনালী মুরগি ৩৩০ টাকা, ব্রয়লার ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা, লেয়ার মুরগি ৩২০ টাকা, সাদা কক ৩১০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

নগরীর গাঙ্গিনারপাড় এলাকার প্রেস ক্লাবের নিচে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন পরেশ দাস। তার সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলের মাঝে এক ছেলে বিয়ে করেছেন। ছেলের বউ নিয়ে পাঁচজনের সংসার।

তিনি বলেন, ৪০ বছর ধরে এ কাজই করছি। আমার ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। দিনের পর দিন যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে, আমার ভাগ্যের অবনতি হয়েছে। আগে তো মাংস বছরে একবার হলেও কিনে খেতে পারতাম। এখন তাও পারি না। করোনার পরে খাসির মাংস কিনে খেতে পারি না। কারণ, এখন দৈনিক ৪০০ টাকার মতো রোজগার করতে পারি। এই টাকা চাল, ডাল, তেল, সবজি কিনতেই লাগে। মাংস কেনার টাকা থাকে না।

jagonews24

সবজি বিক্রেতা আকরাম হোসেন বলেন, বাজারে শীতের সবজি কমে আসছে। তাই, কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। তিনি বলেন, সিম ৩৫ টাকা, লাউ ৬০ টাকা, ফুলকপি-বাঁধাকপি ৩০ টাকা, টমেটো ৩০ টাকা, গাজর ৪০ টাকা, শশা ৩৫ টাকা, বেগুন ৪০ টাকা, মটরশুঁটি ৬০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া সজনে ১৮০ টাকা, এলাচি লেবু ৩৫ টাকা হালি, পাতি লেবু ৩০ টাকা হালি, ধুন্দল ৫০ টাকা কেজি, পটল ৮০ টাকা, করলা ৭০ টাকা, বরবটি ১৫০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা কেজি, কাঁচকলা ৩০ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে।

একই বাজারের মাংস বিক্রেতা হেলাল মিয়া বলেন, রোজার পরেই ঈদ। যে কারণে এখন বাজারে গরু-খাসি বিক্রি কমে গেছে। তাই গরুর মাংস সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ টাকা বেড়ে ৭৫০ টাকা, খাসির মাংস এক হাজার টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে, দেশি মুরগির ডিম ৭০ টাকা, সোনালী মুরগির ডিম ৬০ টাকা, ফার্মের মুরগির ডিম ৪৫ টাকা, হাঁসের ডিম ৬৫ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে।

jagonews24

মেসার্স সুরুজ এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা আব্দুল খালেক বলেন, সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের ডালের দাম কেজিতে এক থেকে দুই টাকা করে কমেছে। তিনি বলেন, অ্যাংকর ডাল ৬৩ টাকা, খেসারি ডাল ৭৬ টাকা, ছোলা বুট ৮৪ টাকা, বুটের ডাল ৮৫ টাকা, মসুর ডাল বিদেশি ৯৫ টাকা, দেশি মসুর ডাল ১২৫ টাকা, ভাঙা মসুর ৯২ টাকা, মাসকলাই ১১০ টাকা, মাসকলাই ডাল ১৫০ টাকা, মুগডাল ১১৫ টাকা, চিনি ১১৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

ওই বাজারের মাসুদ মিয়া স্টোরের বিক্রেতা মাসুদ মিয়া বলেন, পেঁয়াজ চার টাকা বেড়ে ৩৪ টাকা, রসুন ২০ টাকা কমে ৩০ টাকা, আদা ৯০ টাকা, হলুদ ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

মাছ মহালের মাছ বিক্রেতা হিমেল মিয়া বলেন, মাছের দাম কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। তেলাপিয়া ২০০ টাকা, পাঙাশ ১৮০ টাকা, সিলভার মাছ ২৬০ টাকা, রুই ৩২০ টাকা, রাজপুটি ২৫০ টাকা, কাতলা ৩৫০ টাকা, চাপিলা ৭০০ টাকা, বাইম এক হাজার টাকা, মলা ৪০০ টাকা, টাকি ৪০০ টাকা, পাবদা ৩৫০ টাকা, টেংরা ৫০০ টাকা, বোয়াল ৮০০ টাকা, মাগুর ৪০০ টাকা, শিং ৩৫০ টাকা, কই ২৫০ টাকা, আইড় মাছ এক হাজার টাকা, ফলি মাছ ৫০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ৬৫০ টাকা, চিতল ৬৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

নগরীর গাঙ্গিনারপাড় এলাকায় কথা হয় অটোরিকশাচালক মো. আনারুল ইসলাম সঙ্গে। তিনি জেলার তারাকান্দা উপজেলার বাসিন্দা। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে পাঁচ জনের সংসার। বসবাস করেন মহানগরী তিনকোনা পুকুরপাড় এলাকার ভাড়া বাসায়। গত দুইদিন ধরে অটোরিকশার জমা ৫০ টাকা করে বেড়ে ৫৫০ টাকা হয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে ১১০০ টাকা ১১৫০ টাকার রোজগার করা সম্ভব হয়। বাকি টাকা ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় চাল, ডাল, তেল, বাসা ভাড়া, ওষুধ খরচ চলে না। প্রায়ই বাড়িতে গিয়ে ধারদেনা করে টাকা আনতে হয়।

মঞ্জুরুল ইসলাম/এমআরআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।