কুষ্টিয়ায় তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব শুরু
এ কোন উদাসী ডাক? কোনো দাওয়াত নেই, পত্র নেই। তবুও মানুষ ছুটে আসে দলে-দলে, হাজারে-হাজারে। তিন দিনব্যাপী এ উৎসবকে ঘিরে যেন মানুষের ঢল নামে লালনের আখড়া বাড়িতে। শহরের সব রাস্তা গিয়ে মেশে আখড়া বাড়িতে। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের তিন দিনব্যাপী স্মরণোৎসবকে ঘিরে সাধু-ভক্তদের পদচারণায় মুখরিত এখন লালনের আখড়া বাড়ি।
শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে তিন দিনব্যাপী এ লালন স্মরণোৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। লালন একাডেমির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়া-১ আসনের সাংসদ আঃ কাঃ মঃ সরওয়ার জাহান বাদশা, কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যরিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ, পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম, কুষ্টিয়া জজ কোর্টের পিপি অ্যাড: অনুপ কুমার নন্দী, কুষ্টিয়া নাগরিক কমিটির সভাপতি ডা. এস এম মুস্তানজীদ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. শাহিনুর রহমান। প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার রাতে শুরু হয়ে থাকে এ লালন স্মরণোৎসব। তবে এবার পবিত্র লাইলাতুল বরাত’র কারণে দুইদিন আগে শনিবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার লালন আঁখড়াবাড়িতে শুরু হয় তিনদিনের লালন স্মরণোৎসব।
আয়োজনকে ঘিরে ছেঁউড়িয়ায় মরা কালিগঙ্গা নদীর তীরের আখড়াবাড়িতে সাজ সাজ রব বিরাজ করছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমির উদ্যোগে প্রতি বছরের ন্যায় তিন দিনব্যাপী এ আয়োজনে এবারও লালনের কর্মময় জীবন ও দর্শন নিয়ে আলোচনা সভা, দেশি-বিদেশি শিল্পীদের পরিবেশনায় লালন সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
এছাড়াও মূল মাজারের সামনে মরা কালী নদী প্রাঙ্গণে বসেছে গ্রামীণ মেলা। এরই মধ্যে এই আয়োজনকে ঘিরে দেশের দূর-দুরান্ত থেকে লালন ভক্ত ও সাধুরা লালনের মাজার প্রাঙ্গণে আসন গেড়ে বসেছেন। এবারের লালন স্মরণোৎসবের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’
উৎসবকে ঘিরে সাধু ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত সাঁইজির ধাম। পরিবার পরিজনসহ অনেক দর্শনার্থী আসছেন ছেঁউড়িয়ায়। মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইজি জীবদ্দসায় শিষ্যদের নিয়ে দোল পূর্ণিমায় ছেঁউড়িয়ার কালীগঙ্গা নদীর তীরে সারা রাত ধরে তত্ব কথা আলোচনা ও গান বাজনা করতেন। আজ আর কালী গঙ্গায় স্রোত নেই, মানুষ তাই নাম দিয়েছে মরাকালী গঙ্গা।
তবে নদীর স্রোত থেমে গেলেও সাঁইজির ভক্তরা থেমে যাননি। তার মৃত্যুর পরও ভক্ত-শিষ্যরা এ বিশেষ দিনটি পালন করে আসছেন বছরের পর বছর ধরে। তবে এবছর সেই নিয়মে হচ্ছে লালন স্মরণোৎসব। আগামী ৬ মার্চ দোল পূর্ণিমার রাতে লালন স্মরণোৎসবের উদ্বোধনের নিয়ম থাকলেও ৭ মার্চ পবিত্র লাইলাতুল বরাতের কারণে দুইদিন আগেই শনিবার উদ্বোধন হয় স্মরণোৎসব।
এ উৎসবে যোগ দিতে এরই মধ্যে দেশের নানা প্রান্ত থেকে বাউল তীর্থভূমি ছেঁড়িয়ার আখড়াবাড়িতে ছুটে এসেছেন সাধু-গুরু, বাউল ভক্তরা। ছোট দলে ভাগ হয়ে দরদ ভরা গলায় গেয়ে চলেছেন লালনের গান। আবার কেউ বা মেতে উঠেছেন গুরুবাদি বাউল ধর্মের নিগুড় তত্ত্ব কথার আলোচনায়। এসেছেন দেশ বিদেশের নানা বয়সী দর্শনার্থীও।
আয়োজনকে ঘিরে মাজারকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। রাতে লাল-নীল আলোক সজ্জা, বিশাল তোরণ, মাজারের বাইরে বিস্তৃণ কালী নদীর পাড়ে তৈরি করা হয়েছে লালন মঞ্চ। সামনে বিশাল ছামিয়ানা টানানো হয়েছে। আলোচনা মঞ্চের চারপাশ লালন মাজারের প্রধান রাস্তাজুড়ে বসেছে গ্রামীণ মেলা। প্রেম ভক্তি আর ভালোবাসার টানে লালন ভক্ত অনুসারীরা জীবনের মধ্যে নতুন জীবন খুঁজে পাওয়ার শিক্ষা নিয়ে লালনের আখড়া বাড়িতে আসতে শুরু করেছেন। মূল মাজারের ভেতরে ছোট-ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ফকির-বাউলরা আসন পেতে বসেছেন।
ভাববাদী লৌকিক ভাবাদর্শের স্রষ্টা বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই। তার জীবদ্দশায় এমন ফাল্গুনের জোৎনালোকের রাত্রিতে প্রতি বছর চৈত্রের দোল পুর্ণিমা রাতে বসত সাধুসঙ্গ। এই উৎসবের একটা ভিত্তি হচ্ছে ঠিক এমনি এক দোলের দিনে লালন সাঁইজির আবির্ভাব ঘটেছিলো ছেঁউড়িয়ার কালী নদীর ঘাটে। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক তার মৃত্যুও পরও এ উৎসব চালিয়ে আসছেন তার অনুসারীরা।
আল-মামুন সাগর/এমআরএম/এমএস