দেশের চাহিদা পূরণে সক্ষম ফুলবাড়িয়ার হাতে তৈরি লাল চিনি
প্রায় ২০০ বছর যাবত ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আখ থেকে হাতে লাল চিনি তৈরি করছেন কৃষকরা। সরকারি সহায়তা না পাওয়া, শ্রমিক সংকট, মজুরি বৃদ্ধি ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে এখন অন্য পেশায় ঝুঁকছেন কৃষকরা। সরকারি সহায়তা পেলে দেশের চিনির চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এই লাল চিনি।
জেলা কৃষি অফিস জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ময়মনসিংহ জেলায় ২ হাজার ৬৫৯ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৩২ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন আখ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ফুলবাড়িয়া উপজেলায় ১ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে ৬৪ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদন হয়ে।
আরও পড়ুন- খাল কাটা নিয়ে দ্বন্দ্ব, অনিশ্চিত ৭০০ একর জমির চাষাবাদ
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় ২ হাজার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ফুলবাড়িয়া উপজেলায় ৯২০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে। তবে আখচাষের মৌসুম শেষ না হওয়ায় উৎপাদনের হিসাব করা হয়নি। অর্থাৎ গত এক বছরে জেলায় আখের চাষ কমেছে ২৬২ হেক্টর এবং ফুলবাড়িয়া উপজেলায় কমেছে ৩৬০ হেক্টর।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার অন্য উপজেলা থেকে ভালুকা ও ফুলবাড়িয়া উপজেলায় তুলনামূলক বেশি আখ চাষ করা হয়। এর মাঝে ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাকতা, রাধাকাই, আছিম ইউনিয়ন উল্লেখযোগ্য। তবে আখ থেকে লাল চিনি উৎপাদনে এগিয়ে রাধাকানাই ইউনিয়নের পলাশতলী গ্রাম। এক সময় এই গ্রামের প্রায় সব পরিবার লাল চিনি তৈরিতে জড়িত ছিল। তবে বিগত কয়েক বছরে পলাশতলী গ্রামের কৃষকরা আখচাষ ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিচ্ছেন।
প্রায় ২০০ বছর যাবত পলাশতলী গ্রামের কৃষকরা নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে আখ থেকে লাল চিনি উৎপাদন করে আসছেন। কৃষকরা এক সময় গরু দিয়ে ঘানির মতো তৈরি করে আখ থেকে রস বের করতেন। এখন আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগায় ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিনের সাহায্যে আখ থেকে রস বের করে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে লাল চিনি তৈরি করেন।
হাতে লাল চিনি তৈরির প্রক্রিয়া
পলাশতলী গ্রামের কৃষকরা ফাল্গুন মাসে আখ কেটে বীজ খণ্ড সংগ্রহ করেন। এই মাসেই বীজতলায় রোপা আখের চারা তৈরি করেন। সেই চারা বৈশাখ মাসে বৃষ্টিপাতের সময় জমিতে রোপণ করেন। এসব এলাকায় বেশ বৃষ্টি হওয়ায় আখচাষে সেচের প্রয়োজন হয় না। নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে ৯ থেকে ১০ মাসে পরিপক্ক আখ হয়। আমন ধান কাটার পর পৌষ-মাঘ-ফাল্গুন মাসে আখ থেকে লাল চিনি তৈরির কাজ শুরু করেন।
প্রথমে আখ কেটে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত মাড়াই কলের সাহায্যে তা থেকে রস বের করা হয়। তার পাশেই তৈরি করা হয় জ্বাল ঘর। সেখানে তৈরি করা হয় ৭টি চুলা। জ্বাল ঘরের চুলায় ৭টি লোহার কড়াই বসানো হয়। তারপর প্রথম কড়াইয়ে পরিমাণমতো কাঁচা রস দিয়ে জ্বাল দেওয়া শুরু করা হয়। জ্বাল দেওয়ার আধা ঘণ্টা পর প্রথম কড়াই থেকে দ্বিতীয় কড়াইয়ে, তারপর তৃতীয় কড়াইয়ে এভাবে সপ্তম কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া রস নারিকেলের মালাইয়ের হাতা দিয়ে স্থানান্তর করা হয়।
আরও পড়ুন- ভাষাশহীদ আবদুল জব্বারের বাড়িতে মানুষের ঢল
সপ্তম কড়াইয়ে রস দিয়ে তা পরিষ্কার করার জন্য শিমুল গাছের কচি ডালের রস ব্যবহার করা হয়। কড়াইয়ে শিমুলের রস দেওয়ার কিছুক্ষণ পর আখের রস থেকে কালো ময়লা আলাদা হয়ে কড়াইয়ের ওপর ভেসে ওঠে। সেই ময়লা হাতল দিয়ে আলাদা করা হলে আখের রস পরিষ্কার হয়ে যায়। পরে আরও কিছুক্ষণ জ্বাল দিলে তা ঘন হয়ে ওঠে। ঘন রস চুলা থেকে নামিয়ে কাঠের তৈরি মুগুর দিয়ে বারবার ঘর্ষণ করে দানাদার বাদামি রঙের লাল চিনি তৈরি করা হয় এবং তা রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।
আখচাষিদের দাবি
আখ চাষে কোনো সরকারি সহায়তা না থাকা ও স্থানীয় কৃষি অফিস কোনো খোঁজখবর না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এখানকার কৃষকরা। তাদের দাবি আখচাষে সরকারি সহায়তা পেলে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দেশের চিনির চাহিদা পূরণ, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।
পলাশতলী গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা বলেন, এটা আমাদের বাপ-দাদার পেশা। এখন আমরাও এই পেশায় নিয়োজিত। আমি ৪৫ থেকে ৫০ বছর যাবত এই লাল চিনি তৈরি করে আসছি। আমার বাবা নাইব আলী, তার বাবা সাবেদ আলী এই লাল চিনি তৈরি করেছেন। বাবাকে বলতে শুনেছি তার দাদা ইউসুফ আলী শেখও লাল চিনি তৈরির কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, এই গ্রামে প্রতি পরিবার এই পেশায় জড়িত ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত অনেক কৃষক এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছে।
আরও পড়ুন- মজুরি বাড়লেও খুশি হতে পারছেন না শ্রমিক, বিপাকে বোরো চাষি
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আখচাষে অনেক পরিশ্রম। কোনো শ্রমিক এই কাজ করতে চায় না। কাজ করলেও দৈনিক হাজার টাকা মজুরি দিতে হয়। সরকারি কোনো সহায়তা নেই, খরচ বেড়েছে, লাভের চায়তে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। তাই এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। সরকার যদি আমাদের এই পেশার দিকে নজর দেয় তাহলে এটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
পলাশতলী গ্রামের নেঞ্জিরপাড়া এলাকার জয়নাল আবেদিন বলেন, আমাদের এখানে সাড়ে ৬ শতাংশে এক কাঠা হয়। এই হিসাবে আমি এ বছর ১৩ কাঠা জমিতে আখচাষ করেছি। আমাদের প্রতি কাঠার আখ দিয়ে ৫ মণ থেকে সাড়ে ৫ মণ চিনি উৎপাদন করা সম্ভব হয়। আমি যে চিনি তৈরি করেছি এটার দাম ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। তবে অন্যরা ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতেও চিনি বিক্রি করে। আমাদের হাতে তৈরি করা এই চিনিতে কোনো কেমিকেল ব্যবহার করা হয় না। সামান্য খাবার সোডা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আবু রায়হান বলেন, আখচাষে সরকার থেকে প্রণোদনা দেওয়া হয় না। আখচাষের মৌসুমে মাঠ দিবস করে কৃষকদের আখচাষ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। তবে সরকার থেকে প্রণোদনা দিলে এই লাল চিনি দেশের চিনির চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে।
এফএ/এএসএম