দুই মাসের ব্যবধান, ভরা নদী এখন ধু ধু বালুচর
কয়েক মাস আগে যে নদীতে ভরা জল ছিল দুই মাসের ব্যবধানে তা ধু ধু বালুচরে রূপ নিয়েছে। ফলে পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যাচ্ছে। তিস্তা নদীর বর্তমান চিত্র এটি।
এদিকে, নদীতে পানি না থাকায় তিস্তাপাড়ের জেলেরা পড়েছেন বিপাকে। আর ধুধু বালুচরে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, কুমড়া, গম, ভুট্টা, আলু, ডাল চাষ করছেন কৃষকরা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তিস্তা ব্যারাজের ৫২টি গেটের মধ্যে ৪৫টি বন্ধ করে উজানের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। নদীর উজানে যেটুকু পানি জমছে তাতেই ব্যারাজটির বাকি সাতটি গেটের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু চলতি সপ্তাহে পানিপ্রবাহ মাত্র ১৫০০ কিউসেকে ওঠানামা করায় সেচের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের ব্যারাজটির ৩০টি গেট বালুচরে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যারাজের পাশে কিছু অংশে পানি থাকলেও তা পুকুরে পরিণত হয়েছে। নদীর স্রোত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
নদীর মাঝখানে বালুচরে পড়ে আছে কিছু নৌকা। পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম থেকে লালমনিরহাট রেলসেতু পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার জুড়ে তিস্তার চরে বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ হয়েছে। নদীতে পানি না থাকায় কৃষকরা নদীর মাঝখানে শ্যালো মেশিন বসিয়ে সেচ দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন: ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে উত্তরের রূপ বদলে যাবে’
গত বছরের মাঝ থেকে শেষেরদিকে টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে তিস্তা নদী। ওই সময় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘তিস্তা ব্যারাজ’ রক্ষায় খুলে দেওয়া হয় ৫২টি গেট। এতে শুধু ব্যারাজের উজানের বাসিন্দারাই নন, ভাটিতে থাকাও লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। তিস্তার ভাঙনে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শোলমারী, আদিতমারী এলাকার মহিষখোচা ও লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ এলাকায় বসতভিটাসহ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার।
একসময়ের প্রমত্তা তিস্তার নাব্য এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে, আসন্ন রবি মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে। প্রতিদিনই পানি কমছে। কোথাও সামান্য পানি আবার কোথাও দিগন্তজোড়া বালুচর। ব্যারাজ থেকে শুরু করে তিস্তার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পানি না থাকায় শঙ্কায় পড়েছেন কৃষক।
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় একদিকে যেমন বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে তেমনি শুষ্ক মৌসুমেও তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে ভারত তাদের গোজলডোবা নামে বাঁধের সাহায্যে একতরফাভাবে পানি আটকিয়ে বাংলাদেশের উত্তর জনপদের লাখ লাখ কৃষকের বোরা চাষাবাদ ব্যাহত করছে।
আরও পড়ুন: শিগগির তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করতে পারবো: চীনা রাষ্ট্রদূত
এদিকে, ভারত-বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ে কয়েকবার বৈঠক হলেও আজও তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। ফলে নব্যতা হারাতে বসেছে তিস্তা নদী। এই অবস্থায় পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে তিস্তা নদী বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছেন লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরসহ তিস্তার সেচ নির্ভর মানুষজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে যে হারে পানি প্রবাহ কমে আসছে তাতে করে শিগগির কাঙ্ক্ষিত পানি চুক্তি সম্পন্ন না হলে, মরা খালে পরিণত হতে পারে তিস্তা নদী। অন্যদিকে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে হাজার হাজার হেক্টর জমি রক্ষা পাবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে তিস্তাপাড়ের মানুষের।
জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু হয় ১৯৯৮ সালে। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিতে পারার কথা এই প্রকল্পে।
হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানী গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য আয়নাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, গত কয়েক মাস আগে চীনের রাষ্ট্রদূত তিস্তা ব্যারাজ এলাকা ঘুরে গেছেন। আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবেই। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে আমাদের আর অভাব থাকবে না।
হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না গ্রামের আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিবছর তিস্তার পানি নেমে যাওয়ার একমাস পরেই তিস্তায় জেগে ওঠা চরে ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করি। চাষাবাদ করে যে আয় হয় সে দিয়ে সংসার চলে।
তিস্তাপাড়ের জেলে কদম আলী জাগো নিউজকে বলেন, তিস্তায় বর্তমানে কোনো পানি নেই। পানি না থাকায় মাছ পাচ্ছি না। প্রতিবছর পাঁচ থেকে ছয় মাস আমাদের কষ্ট হয়। তাই কয়েক মাস ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে সংসার চালাই।
আরও পড়ুন: তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশ্বস্ত করলো ভারত
সানিয়াজান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাসেম তালুকদার বলেন, তিস্তাপাড়ের মানুষের একটাই দাবি, নদী খনন করে টেকসই বাঁধ নির্মাণ এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তিস্তাপাড়ের কয়েক লক্ষাধিক মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে। প্রতিবছর তিস্তার চরের মানুষ বর্ষা ও খরায় যুদ্ধ করে বেঁচে আছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ-দৌলা জাগো নিউজকে বলেন, চলতি বছরের তিস্তার পানি ভালো পাওয়া যাচ্ছে। ইরি ধান চাষের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমানে তিস্তার পানি ২১০০ কিউসেক রয়েছে। তিস্তার মূল্য নদীতে পানি নেই। সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আশা করি, ইরি কার্যক্রমে পানির সংকট হবে না। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন। এই পানি দিয়ে ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি ধান আবাদ হবে।
এমআরআর/জিকেএস