অপরাধে জড়াচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা
জনগণকে সুরক্ষা ও সেবা দেওয়ার বদলে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে লক্ষ্মীপুরের বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে। তারা জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, মাদক কারবারি, নারী নির্যাতন, জমি দখল, প্রতারণা ও মারধরের অভিযোগে মামলা রয়েছে।
গত দেড় বছরে অর্ধশতাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে মামলা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানসহ অনেকেই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য পেয়েছে জাগো নিউজ।
সবশেষ গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু ইউছুফ ছৈয়ালের বিরুদ্ধে যুবলীগ নেতা সবুজকে কুপিয়ে আহত করার অভিযোগে থানায় মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় ইউছুফের তিন ছেলেকেও আসামি করা হয়।
আরও পড়ুন: উপজেলা চেয়ারম্যানকে মারধর করলেন এমপি
ভুক্তভোগী মো. সবুজ বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ইউছুফ ছৈয়ালের নির্দেশেই তার ছেলেরা আমাকে হত্যাচেষ্টা করেছেন। এ ঘটনায় আমার স্ত্রী বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলা তুলে নিতে আসামিরা আমাদের হুমকি দিচ্ছেন। পরিবার নিয়ে আমি এখন নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।
এর আগে গত ৩ জানুয়ারি একই পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মনির হোসেন সজিবকে ৮৫ হাজার ২০ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়। তিনি চররমনী ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক। এ ঘটনায় সদর মডেল থানায় মামলা হয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জেলা, উপজেলা পর্যায়ের সিনিয়র নেতাদের মদতে জনপ্রতিনিধিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। জনপ্রতিনিধিদের ছেলে, ভাইসহ পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা কারণে-অকারণে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রভাব-আধিপত্য বিস্তার করতে সংঘাতে জড়াচ্ছেন।
যুবদল নেতা আনোয়ার হোসেন হত্যা মামলায় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইসমাইল হোসেন সবুজের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
আরও পড়ুন-সালিশে নারী ইউপি সদস্যকে জুতাপেটা করলেন চেয়ারম্যান
জনগণকে মারধর ও হয়রানির ঘটনায় উচ্চ আদালত লক্ষ্মীপুরের তিন ইউপি চেয়ারম্যানকে সশরীরের তলব করেছিলেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেওয়ার নির্দেশের পাশাপাশি ভর্ৎসনা করা হয়।
দত্তপাড়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আহসানুল কবির রিপনের ঘটনায় রায়ের কপি দেশের সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের কাছে পাঠানোর জন্য স্বরাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এরপরও লক্ষ্মীপুরে জনপ্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য থামেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর জেলায় মোট ৮৪০ জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। এর মধ্যে এমপি চারজন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান-সদস্যসহ আটজন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পাঁচজন, ভাইস চেয়ারম্যানসহ ১৫ জন, পৌরসভার মেয়র চারজন, কাউন্সিলরসহ ৫৯ জন, ৫৮ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান, সদস্য (মেম্বার), সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য ৭৫৪ জন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি জনগণকে সুরক্ষার বদলে হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, চুরি, প্রতারণা ও মারধরের অভিযোগ রয়েছে। অনেকেই আবার নাশকতায় জড়িত এবং সরকারবিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পলাতক।
আরও পড়ুন: নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর, কারাগারে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান
থানা পুলিশ, আদালত ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউপি চেয়ারম্যান আবু ইউছুফ ছৈয়াল, মান্দারীর সোহরাব হোসেন রুবেল পাটোয়ারী, ভবানীগঞ্জের সাইফুল হাসান রনি, কুশাখালীর ছালেহ উদ্দিন মানিক, রামগতি উপজেলার চর বাদামের শাখায়াত হোসেন জসিম, চর পোড়াগাছার নুরুল আমিন, রামগঞ্জ উপজেলার ইছাপুরের আমির হোসেন খান, লামচরের ফায়িজ উল্যা জিসান, রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চর আবাবিলের হাওলাদার নুরে আলম জিকু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এরমধ্যে সম্প্রতি প্রতারণা মামলায় আবু ইউছুফ ছৈয়াল একমাস ১০ দিন কারাগারে ছিলেন।
সূত্র জানায়, লক্ষ্মীপুর পৌরসভার কাউন্সিলর রিয়াজ পাটোয়ারী রাজু, সদরের চররমনী মোহনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য নয়ন বেগম, সদস্য আবদুর রহমান স্বপন, চরশাহীর ফখরুল ইসলাম ও মো. দাউদ, মান্দারীর জাকির হোসেন, দিঘলীর তাজুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম স্বপন, দত্তপাড়ার ইসমাইল হোসেন সবুজ, ভাঙ্গাখার মো. শাহজাহান, রায়পুরের চরপাতার মোরশেদ আলম, উত্তর চরআবাবিলের আবদুল বারেক মাঝি ও মহিউদ্দিন গাজী, দক্ষিণ চরবংশীর নজরুল ইসলাম, দক্ষিণ চরআবাবিলের আবদুল হালিম সর্দার ও আবু জাফর, রামগঞ্জের নোয়াগাঁওয়ের রফিকুল ইসলাম এবং মোজাম্মেল হক পলাশ, ইছাপুরের মামুনুর রশিদ সবুজ বানিয়া ও ফয়েজ আহমেদ দুখু, দরবেশপুরের সোহাগ হোসেন, কমলনগরের হাজীরহাটের হাসান মাহমুদ আপেল, ফলকনের নাজিম উদ্দিন, সাহেবের হাটের হেলাল উদ্দিন, চরমার্টিনের ওমর ফারুক মুন্সি, চরকাদিরার হারুনুর রশিদ, তোরাবগঞ্জের ইসমাইল হোসেন, রামগতির চরবাদামের আবদুর রহিম ও চরগাজীর শেখ ফরিদের বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে মামলা রয়েছে। চরগাজীর শেখ ফরিদের বিরুদ্ধে র্যাবের ওপর হামলার ঘটনাসহ অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে।
আরও পড়ুন: ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ভাঙচুর ও মারধরের অভিযোগ
লক্ষ্মীপুর পৌরসভার কাউন্সিলর রিয়াজ উদ্দিন পাটোয়ারী রাজুর বিরুদ্ধে ২৩ জানুয়ারি থানায় মামলা করেন কাজী ওসমান গণি।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘জমি নিয়ে বিরোধের জেরে আমার ভাই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনাস কামালের ওপর সহযোগীদের নিয়ে কাউন্সিলর প্রকাশ্যে হামলা চালান। পরে হয়রানির জন্য তারা পাল্টা আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মারধরের একটি ভিডিও তখন ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রায়পুর উপজেলার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, “চেয়ারম্যান-মেম্বাররা নাগরিকদের পদে পদে হয়রানি করছেন। টাকার জন্য তারা যেন ‘খাই খাই’ করেন। কোনো কাজ নিয়ে গেলে তারা ‘ভুটানের রাজার’ মতো ভাবে থাকেন।”
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাইন উদ্দিন পাঠান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগের দিনে সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক আর মেলবন্ধ তৈরি করে জনপ্রতিনিধি হতেন। তারা সম্মানিত ছিলেন। এখন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত-মনোনীত হচ্ছেন। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে তাদের বৈধ-অবৈধ টাকার প্রয়োজন। এজন্য যখন যা ইচ্ছে, লাগামহীনভাবে তাই করছেন।’
আরও পড়ুন: বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর, চেয়ারম্যান বরখাস্ত
‘এখন বেশিরভাগ চেয়ারম্যান-মেম্বার অবৈধ পন্থায় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন’ বলে মনে করেন জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আইনজীবী হাছিবুর রহমান।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এজন্য জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নেই। সহনশীল আচরণ এবং আইনে তাদের কী ক্ষমতা নির্ধারিত আছে, তা অনেকেই জানেন না। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই জনবান্ধব ব্যক্তিরাই নির্বাচিত হবেন, জনগণও এর সুফল পাবেন।’
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরান হোসেন বলেন, ‘মাসিক আইনশৃঙ্খলা ও সমন্বয় সভায় জনপ্রতিনিধিদের সতর্কভাবে দায়িত্ব পালন করার জন্য বলা হয়। দায়িত্ববোধহীন, নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে কিছু চেয়ারম্যান-মেম্বার অপরাধে জড়াচ্ছেন। এরই মধ্যে আমরা কয়েকজনকে বরখাস্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সুপারিশ পাঠিয়েছি।’
আরও পড়ুন: নারী মেম্বারকে মারধর করায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) জসিম উদ্দিনের মতে, অদক্ষ জনপ্রতিনিধিরাই বিতর্কে জড়াচ্ছেন। এজন্য নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. শাহজাহান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের কাছে জনগণ সহনশীল আচরণ ও সুরক্ষা প্রত্যশা করে। ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে দেশ ও সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত থাকতে পারলেই জনপ্রতিনিধিদের অপরাধবোধ কমে যাবে।
এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন বলেন, জনগণের সেবায় আমরা রাতদিন কাজ করছি। জনপ্রতিনিধিদের কেউ অতি উৎসাহী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে।
জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মাহফুজ্জামান আশরাফ বলেন, কোনো জনপ্রতিনিধি যদি ফৌজদারি অপরাধ করেন তাহলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমরাও সেটি করছি। তবে কেন অপরাধে জড়াচ্ছেন সেটি তারাই বলতে পারবেন।
এসআর/এএসএম