গাইবান্ধায় ৬৬ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহীদ মিনার
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে বীর বাঙালি রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। তাদের স্মৃতি স্মরণ করতে নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত এই দিনটি স্মরণে শহীদ মিনারে নিবেদন করা হয় শ্রদ্ধার্ঘ।
কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পরও গাইবান্ধার অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা ও কলেজে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গড়ে ওঠেনি শহীদ মিনার। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, অর্থ বরাদ্দ না থাকাসহ নানা কারণে দীর্ঘদিনেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে স্মৃতির মিনার নির্মাণ করা যায়নি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধায় প্রায় ৬৬ শতাংশ (৬৫ দশমিক ৭৩) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহীদ মিনার। গাইবান্ধায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪৬৫টি। এর মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৫০২টি বিদ্যালয়ে, অর্থাৎ শহীদ মিনার আছে ৩৪ দশমিক ২৬ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
১৯৬২ সালে স্থাপিত গাইবান্ধা জেলা শহরের ভি-এইড রোডে জুবলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া শিমু বললো, বইয়ের পাতায় ছবি আর টেলিভিশনে শহীদ মিনার দেখেছি। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সেখানে মানুষ ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। শহীদ মিনারে গান, কবিতা পাঠের আসর ও নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখেছি। কিন্তু আমাদের স্কুলে শহীদ মিনার নেই। তাই আমরা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি না।
এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো হারুনর রশিদ বলেন, বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের কোনো বরাদ্দ নেই। তবে একটি নির্দেশনা আছে, সব বিদ্যালয়ে একই আকার ও আয়তনের শহীদ মিনার নির্মাণ করতে হবে। যারা নিজস্ব উদ্যোগে শহীদ মিনার নির্মাণ করবে, তাদের জন্যই এই নির্দেশনা।
তিনি বলেন, বাঙালি চেতনা ও আমাদের জাতিসত্তার প্রথম উন্মেষ ঘটে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ভাষা শহীদদের প্রতি যথার্থ মর্যাদা দিতে হলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ জরুরি।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা যায়, গাইবান্ধার সাতটি উপজেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ৪২২টি। এর মধ্যে শহীদ মিনার নেই ১৮১টিতে, অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই।
গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ৭০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৩টিতে শহীদ মিনার আছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৮৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৭০টিতে, পলাশবাড়ীতে ৪৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১৩টিতে, সাঘাটায় ৪৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১৩টিতে, সাদুল্লাপুরে ৬৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৪টিতে, সুন্দরগঞ্জে ৮৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৯টিতে ও ফুলছড়ি উপজেলায় ১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৯টিতে শহীদ মিনার রয়েছে।
এ ছাড়া গাইবান্ধা জেলায় মাদরাসা আছে ২১৩টি। এর মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৮২টিতে। শহীদ মিনার নেই ১৩১টিতে, অর্থাৎ গাইবান্ধায় ৬১ দশমিক ৫১ শতাংশ মাদরাসায় শহীদ মিনার নেই।
সদর উপজেলায় ২০টি মাদরাসার মধ্যে একটিতে, গোবিন্দগঞ্জে ৫৯টি মাদরাসার মধ্যে ৩৫টিতে, পলাশবাড়ীতে ১৮টি মাদরাসার মধ্যে একটিতে, সাদুল্লাপুরে ৪১টি মাদরাসার মধ্যে ১৭টিতে ও সুন্দরগঞ্জে ৪৯টি মাদরাসার মধ্যে ১৮টিতে শহীদ মিনার আছে। এছাড়া সাঘাটায় ২০টি এবং ফুলছড়িতে ছয়টি মাদরাসা থাকলেও এর কোনোটিতেই শহীদ মিনার নেই।
সদর উপজেলার তুলসীঘাট শামসুল হক ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী শামীম আহম্মেদ জানায়, আমাদের ভাষা আন্দোলন যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ শহীদ মিনার নির্মাণ করা হচ্ছে। অথচ গাইবান্ধার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই, দেখে কষ্ট হয়।
এক অভিভাবক মারুফ হাসান বলেন, গাইবান্ধার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার নেই। নতুন প্রজন্মকে শহীদদের তাৎপর্য জানাতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার তৈরি করা জরুরি।
ধর্মপুর আব্দুল জব্বার ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক নাট্যকর্মী জুলফিকার চঞ্চল বলেন, বাঙালি জাতির অতীত ইতিহাস, লড়াই-সংগ্রাম ও চেতনার প্রতীক শহীদ মিনার। শিক্ষার্থীদের মাঝে জাতিগত চেতনা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করতেই প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা উচিত।
শহীদ মিনারের গুরুত্ব তুলে ধরে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোছা. রোকসানা বেগম বলেন, শহীদ মিনার বীর বাঙালির স্মৃতির স্মারক। ৫২’র ভাষা আন্দোলনকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় দিবসটির গুরুত্ব বেড়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের ভাষা সৈনিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও ভাষা দিবসের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করাতে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা প্রয়োজন।
এ সম্পর্কে নাগরিক সংগঠন ‘জনউদ্যোগ গাইবান্ধা’র সদস্য সচিব প্রবীর চক্রবর্তী বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই, এটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদনের শর্তের মধ্যে শহীদ মিনার নির্মাণ বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব অর্থায়নে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য বলা হয়েছে। এরইমধ্যে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শহীদ মিনার নির্মাণ করছে। বাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে যাতে মিনার নির্মাণ করা হয়।
এমআরআর/এসআর/জেআইএম