বিলুপ্তির পথে শেরপুর সীমান্তের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা

ইমরান হাসান রাব্বী ইমরান হাসান রাব্বী , শেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১১:০১ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

শেরপুর সীমান্তের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য গত তিনবছরেও মেলেনি নিজ ভাষার বই। নিজ ভাষায় পাঠদানের জন্য স্কুলে নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক। নিজেদের ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকা ও পরিবারে চর্চা কমে যাওয়ায় বিলুপ্তির পথে এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা। তাই ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে সরকারের সহযোগিতা চান স্থানীয়রা।

শেরপুরের সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় সাতটি সম্প্রদায়ের প্রায় ৫৪ হাজার মানুষের বসবাস। এর মধ্যে গারো, বর্মণ ও হদি সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যাই বেশি। সম্প্রতি সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেও তা পৌঁছায়নি এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের হাতে। গেলো তিন বছর ধরে স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার শিক্ষার্থীদের বইয়ের চাহিদা ঢাকায় পাঠানো হলেও বই আসেনি শেরপুরে। সবশেষ চলতি ২০২৩ শিক্ষাবর্ষেও প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৪৯০ জনের বইয়ের চাহিদা দেওয়া হলেও এখনো পৌঁছায়নি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি শিক্ষাবর্ষে শেরপুর জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৯০ জন। যার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪০ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১২০, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১১৫, তৃতীয় শ্রেণিতে ১১৫ জন। এর বাইরেও অন্য শ্রেণিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক। তবে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৪৯০ জনের বইয়ের চাহিদা দেওয়া হলেও সে বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায়নি।

এদিকে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর জন্য কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষকও। যার কারণে বাংলা ভাষাতেই শিক্ষাগ্রহণ করতে হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীদের।

ঝিনাইগাতী উপজেলার আপন শিক্ষা পরিবারের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী প্রদীপ কোচ বললো, আমরা বাংলা ভাষাতেই পড়াশোনা করি। বাংলাতেই আমাদের পড়তে হয়। ক্লাসের বাইরেও আমাদের খুব বেশি নিজেদের ভাষায় কথা বলা হয়ে ওঠে না। তাই আমাদের ভাষাটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষক নিধারঞ্জন কোচ বলেন, পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে শিক্ষার্থীরা তাদের ভাষার বই পড়তে পারে। আমাদের এলাকায় এখনো সে বই এসে পৌঁছায় না। আমাদের পক্ষ থেকে অনেকবার এ বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা কর্মকর্তারাও চাহিদা দিচ্ছেন, তবুও বই কেন আসছে না, আমাদের বোধগম্য নয়। আমাদের ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণের জন্য হলেও বইটা জরুরি। আর এর পাশাপাশি প্রয়োজন প্রশিক্ষিত শিক্ষকও।

শুধু পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সংকট নয়, আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবারেও চর্চা কমে যাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা। হেপি হাজং বলেন, সবার আগে পরিবারের শিক্ষাটা জরুরি। এরপর স্কুল আর পাঠ্যপুস্তক। কিন্তু এখনকার সময়ে পরিবারে চর্চাটা একেবারেই কমে গেছে। তাই আরও দ্রুত ভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

ব্রেমিং চিসিম বলেন, আমরাও এখন নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষার ব্যবহার করি না। বাচ্চারা শিখবে কী করে? তাই আমাদের নিজেদেরও সচেতন হওয়া উচিত।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা রক্ষায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইয়ের পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের দাবি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতাদের। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্প (আইইডি) শেরপুরের ফেলো সুমন্ত বর্মণ বলেন, বাংলা ভাষার আগ্রাসনের কারণেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এখনই সরকার যদি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ না নেয়, এই ভাষা টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে স্কুলে স্কুলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের বিকল্প নেই।

শেরপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, প্রতিবছরই চাহিদা দেওয়া হচ্ছে, কেন বই সরবরাহ হচ্ছে না, এটা নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবো। দ্রুত সময়ের মধ্যে বই সরবরাহের বিষয়টি দেখা হবে। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের বিষয়টিও ওপর মহলে জানানো হবে। অবশ্যই সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

এনজিও আইইডির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিসংখ্যানে, বর্তমানে শেরপুর জেলায় গারো ১৬ হাজার ৫০০, হাজং ৪ হাজার ৭০০, হদি ১০ হাজার ৬০০, বর্মণ ১৭ হাজার, কোচ ৩ হাজার ৫০০, ডালু ১ হাজার ১০০, বানাই ১১০ জন বসবাস করছেন। তাই সময়ের সঙ্গে যেন তাদের ভাষা হারিয়ে না যায়, এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ চান শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাসিন্দারা।

এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।