একটি অসমাপ্ত প্রেমের সাক্ষী টেকনাফের ‘মাথিনের কূপ’

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৯:৫০ এএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দেশের সর্ব দক্ষিণের স্থলসীমান্ত শহর কক্সবাজারের টেকনাফ। শহরের লামারবাজার এলাকায় থানা চত্বর। টেকনাফ থানার বিশেষত্ব হলো এখানে রয়েছে একটি বিশেষ কূপ। নাম ‘মাথিনের কূপ’। এক পুলিশ কর্মকর্তা ও রাখাইন জমিদারকন্যা মাথিনের অসমাপ্ত প্রেমের সাক্ষী কূপটি।

শত বছরের পুরোনো এ বিয়োগান্তক প্রেমের কাহিনি থানা চত্বরে সংরক্ষিত কূপঘেরা দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে। বিমোহিত হয়ে সেই গল্প পড়েন পর্যটক ও স্থানীয় দর্শনার্থীরা।

প্রকৃত ঘটনা জানতে ফিরে যেতে হবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। কলকাতার সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য বদলি হয়ে আসেন দুর্গম জনপদ টেকনাফ থানায়। তার থাকার ব্যবস্থা করা হয় থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষেই। প্রায় জনশূন্য টেকনাফে তেমন কোনো কাজ ছিল না এ পুলিশ কর্মকর্তার। তাই দিনের বেলা এলাকার এখানে সেখানে ঘুরে সময় কাটালেও সন্ধ্যা হলে একাকিত্বে আনমনা হতেন ধীরাজ।

jagonews24

ওই সময় পুরো টেকনাফে সুপেয় পানির একমাত্র উপলক্ষ ছিল থানা চত্বরের পাতকুয়া (কূপ)। একদিন ভোরে একাধিক নারী কণ্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভাঙে। থানার ছোট বারান্দায় এসে দেখেন রং-বেরঙের ফতুয়া (থামি-ব্লাউজ) পরিহিত জন বিশেক রাখাইন তরুণী পাতকুয়ার চারদিকে জড়ো হয়ে হাসি-গল্পে মশগুল।

প্রতিদিন তরুণীরা পাতকুয়ায় পানি নিতে আসতেন। ধীরাজ থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে দেখতেন সে দৃশ্য। একদিন ধীরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত এক তরুণীকে। সুন্দরী এ তরুণীর নাক-চোখ পুরো অবয়ব বাঙালি মেয়েদের মতোই। খবর নিয়ে জানলেন মেয়েটি টেকনাফের জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র মেয়ে। নাম মাথিন। প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে মনে ধরে যায় পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজের। এরপর থেকে প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে মাথিনের আসার অপেক্ষায় থাকতেন।

মাথিনও বুঝতে পারছিলেন সুদর্শন এক পুলিশ কর্মকর্তা তার অপেক্ষায় থাকেন প্রতিদিন। এভাবে পানির বাহানায় মাথিনও নিয়মিত কূপে আসতেন। এভাবে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন দুজনে। পরে এ কান ও কান হয়ে দুজনের প্রেমের কথা চারদিকে চাউর হয়। ঘটে নানা বিপত্তি। এরপর দুজনই সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। প্রথমে বাদ সাধলেও মেয়ের আগ্রহে রাজি হন মাথিনের বাবা ওয়ানথিনও।

jagonews24

এরই মধ্যে বিষয়টি ধীরাজের ব্রাহ্মণ বাবার কান পর্যন্ত যায়। তিনি জরুরি টেলিগ্রাফ মারফত অসুস্থতার কথা বলে ধীরাজকে দ্রুত কলকাতা ফিরে যেতে বলেন। ছুটি না মিললে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানান ধীরাজ। তবে মাথিন রাজি হন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ধীরাজ এক সন্ধ্যায় টেকনাফ ছেড়ে একপ্রকার পালিয়ে গেলেন।

ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে সহজে মেনে নিতে পারেননি প্রেমিকা মাথিন। তিনি ধারণা করলেন, বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ধীরাজ তাকে বিয়ের ভয়ে পালিয়েছেন।

মনের মানুষ ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্ন-জল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী। জমিদার বাবা ওয়ানথিনসহ পরিবারের সদস্যরা শত চেষ্টা করেও তাকে কিছু খাওয়াতে পারেননি। একপর্যায়ে ধীরাজের অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে কঙ্কালসার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মাথিন।

https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019November/lk-444-20230214095031.jpg

পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য ও রাখাইন তরুণী মাথিনের ঐতিহাসিক প্রেমের সাক্ষী ‘মাথিনের কূপ’ দেখে এখনো অগণিত প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হন।

১৯৩৫ সালে ধীরাজ ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জীবনী নিয়ে লেখা ‘যখন পুলিশ ছিলাম‘ গ্রন্থে তার অতৃপ্ত ভালোবাসার স্মৃতি প্রকাশ পায়। এনিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর ১৯৮৪ সালের ১৪ এপ্রিল থানা কম্পাউন্ডের সেই পাতকুয়াটি ‘মাথিনের কূপ’ নামে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে সংস্কার করা হয়। এরপর থেকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এটি হয়ে ওঠে পর্যটকদের জন্য এক দর্শনীয় স্থান।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে সদ্য বিয়ে করা বউকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে আসা মো. মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ বইটি ছাত্রজীবনে পড়েছি। তখন থেকেই ইচ্ছা ছিল মাথিন আর ধীরাজের প্রেমের নিদর্শন কূপটি দেখবো। জীবনসঙ্গীসহ দেখার সৌভাগ্য হলো। ভালোবাসার জন্য মাথিনের ত্যাগ সত্যি বিয়োগান্তক, তবে গর্বেরও।

jagonews24

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়মা সুলতানা বলেন, মাথিন-ধীরাজের ভালোবাসার বিষাদময় পরিসমাপ্তি চরম কষ্টের। লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদসহ যুগে যুগে ভালোবাসার জন্য জীবন দেওয়া আরেকটি অমরগাঁথা ধীরাজ-মাথিন। তবে ধীরাজের সঙ্গে মাথিনের অবয়ব হলে কূপের দৃশ্যটি আরও সুনিপুণ হতো বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ব্রিটিশ শাসনামলে আমাদেরই এক পূর্বসূরির অতৃপ্ত ভালোবাসার নিদর্শনটি অতিযত্নে সংস্কার করা হয়েছে। সবার সহযোগিতায় দেশবাসীর কাছে মাথিনের কূপটি হয়ে উঠবে এক আকর্ষণীয় স্থান।

এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।