দিবস ছাড়া পর্যটক মেলে না মৌলভীবাজারে

আব্দুল আজিজ
আব্দুল আজিজ আব্দুল আজিজ , মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: ০৮:৩৮ এএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় মৌলভীবাজার প্রকৃতির অন্যতম লীলাভূমি। একদিকে পাহাড় অন্যদিকে চা বাগান। একদিকে ঝরনা অন্যদিকে বিস্তীর্ণ হাওর। আছে এশিয়ার অন্যতম রেইনফরেস্ট লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বিপুল সম্ভাবনা থাকা মৌলভীবাজারকে সরকার পর্যটন জেলা ঘোষণা করে ২০০৮ সালে। এরপর এক যুগেরও বেশি সময় পার হয়েছে। তবে হয়নি ‘চায়ের দেশ’ ও ‘জলকন্যা’ মৌলভীবাজারের পর্যটনশিল্পের বিকাশ।

পর্যটনশিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা সবুজ চা-বাগান, হাওর, নদী, পাহাড় ও সমতলের বৈচিত্র্যপূর্ণ জনপদ মৌলভীবাজারকে ঘিরে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুদূরপ্রসারী কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। সরকারের সঙ্গে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সমন্বয়হীনতা, অবকাঠামো উন্নয়নের অভাব আরও বিনোদনকেন্দ্রে যাতায়াত ও উন্নতমানের গাইডের অভাবে মৌলভীবাজারের পর্যটনশিল্প বিকশিত হচ্ছে না।

দিবস ছাড়া পর্যটক মেলে না মৌলভীবাজারে

আরও পড়ুন: সেন্টমার্টিন পর্যটক জাহাজে অতিরিক্ত যাত্রী, বালাই নেই নিয়মনীতির

রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যটন জেলা ঘোষণার এতদিন পরও মৌলভীবাজারকে সেভাবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পর্যটক আকর্ষণ, তাদের নির্দেশনা, নিরাপত্তা, আবাসন ও বিনোদনের পরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সংরক্ষিত বনাঞ্চল, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হামহাম ছড়া জলপ্রপাত, বাইক্কা বিল, হাকালুকি হাওর, মাধবপুর লেক ও ইকোপার্ক, ওয়াটার ট্যুরিজমের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে এ জেলায়। তবে নান্দনিকতার অভাবে পর্যটনের বিকাশ আটকে আছে।

দিবস ছাড়া পর্যটক মেলে না মৌলভীবাজারে

পর্যটন বিশেষজ্ঞ সাঈদ নোমান বলেন, একই স্পট বারবার দেখতে পর্যটকরা পছন্দ করেন না। তারা নতুনত্ব চান। মৌলভীবাজারে পর্যটকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটছে না। বিনোদনকেন্দ্রিক আরও নতুন কিছু গড়ে ওঠা দরকার।

আরও পড়ুন: সুন্দরবনে পর্যটক ভোগান্তি

তবে পর্যটন বিভাগ বলছে, পর্যটনের উন্নয়নে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। সরকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। হয়তো এর ফল আসতে একটু দেরি হবে।

দিবস ছাড়া পর্যটক মেলে না মৌলভীবাজারে

শ্রীমঙ্গল টি ভ্যালির স্বত্বাধিকারী এম এ রকিব জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি সহায়তার অভাবে স্থানীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন না। অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব রয়েছে, বিনোদনের নেই কোনো ব্যবস্থা, পর্যটন স্পটে সহজ যাতায়াত ও উন্নতমানের ভ্রমণ গাইডের অভাবে জেলার পর্যটনশিল্প বিকশিত হচ্ছে না। নান্দনিকতা ও বিনোদনের অভাবে পর্যটকরা বিশেষ দিবস ছাড়া এখানে আসছেন না।

মৌলভীবাজার পর্যটন সেবা সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শামছুল হক জাগো নিউজকে বলেন, জেলায় বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে। এ জেলায় দেশের শীর্ষভাগ চা বাগান। রয়েছে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। পর্যটনকেন্দ্রিক যোগাযোগব্যবস্থা ও উন্নতমানের অবকাঠামো না থাকলেও অভ্যন্তরীণ উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, অবকাঠামোগত সুবিধা ও প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্য রয়েছে। পাহাড়, টিলা, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, হাওর-বাঁওড় বিল, ঝরনা, নদ-নদী পরিবেষ্টিত ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এ জেলা ইকো-ট্যুরিজমের জন্য খুবই উপযোগী। এ কারণে প্রতিবছর বহু দেশি-বিদেশি পর্যটক এ জেলায় ভ্রমণে আসেন। কিন্তু পর্যটন স্পট তাদের কাছে আকর্ষণীয় না হওয়ায় অনেকে ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে চলে যান।

দিবস ছাড়া পর্যটক মেলে না মৌলভীবাজারে

আরও পড়ুন: আশানুরূপ পর্যটক নেই কক্সবাজারে, হতাশ ব্যবসায়ীরা

শ্রীমঙ্গলের পর্যটন ব্যবসায়ী ইকবাল আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, শীতের ছুটিতে ভ্রমণপিপাসুরা এলেও বর্ষায় তেমন ভিড় জমে না। এ ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্পে নতুনত্ব আনতে হবে। পর্যটন স্পটে যাতায়াতের সুব্যবস্থা করতে হবে। হাওরকেন্দ্রিক নৌবিহারের ব্যবস্থা করলে বিনোদনের জন্য হয়তো ট্যুরিস্টরা আসতে পারেন। শিশুদের বিনোদনের জন্য আকর্ষণীয় পার্ক গড়ে তুলতে হবে। তবে এসবের জন্য সরকারের সহায়তা প্রয়োজন।

পর্যটন সেবা সংস্থার সভাপতি ও গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী সেলিম আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, আবাসন, বিনোদন ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে পর্যটকরা নিরাশ হন। এ ক্ষেত্রে বিনোদনের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মণিপুরী ও খাসিয়াপল্লি, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হাকালুকি ও হাইল হাওর এবং চা-বাগানগুলোকে সম্পৃক্ত করে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মাধ্যমে সহজেই এ জেলাকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণের উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব।

আরও পড়ুন: বিদেশি পর্যটক আকৃষ্টে উদ্যোগ নেই পর্যটন করপোরেশনের

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের রেঞ্জার মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ট্যুরিস্টদের আকৃষ্টে মৌলভীবাজারে যথেষ্ট বিনোদনের স্থান রয়েছে। এ স্থানগুলো আকর্ষণীয় করে গড়তে উদ্যোগ প্রয়োজন। ট্যুরিস্টরা শুধু জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়ায় আসেন। অনেক সময় লাউয়াছড়ার ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যায়। এতে সংরক্ষিত বন্যপ্রাণীর অসুবিধা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সমস্যা চিহ্নিত করে পরিকল্পনা মতো কাজ করে তাহলে পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।

দিবস ছাড়া পর্যটক মেলে না মৌলভীবাজারে

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ মিটুন জাগো নিউজকে বলেন, ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম আছে। এরইমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রতারণা থেকে পর্যটকদের রক্ষায় উন্নত ওয়েবসাইট করা হবে। উন্নত ভ্রমণ গাইডের সুব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভ্রমণপিপাসুদের বিনোদনে নৃগোষ্ঠীদের কালচার নিয়ে একটি কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। দু-এক মাসের মধ্যেই তা চালু হবে।

আরও পড়ুন: ভরা মৌসুমেও সেন্টমার্টিনে পর্যটক খরা

জেলা পর্যটনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, পর্যটনশিল্প সম্ভাবনাময় করে গড়তে মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। সরকারিভাবে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিছুটা সময় লাগবে। মৌলভীবাজারে হাওরকেন্দ্রিক ওয়াটার ট্যুরিজম করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর বেশি কিছু এখন বলা যাচ্ছে না।

জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, করোনার কারণে মৌলভীবাজারের পর্যটনশিল্পে বড় ধাক্কা লেগেছে। সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্পকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। মৌলভীবাজারে পর্যটকদের আকৃষ্টে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে।

এমআরআর/এএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।