আলুতে স্বপ্নভঙ্গ কৃষকের
আলু নিয়ে সংকট কৃষকের যেন কাটছেই না। দাম বাড়ার আশায় জমিতেই ফেলে রাখা হয়েছে হাজার হাজার মণ আলু। তবে অস্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত দাম ওঠানামার কারণে কৃষকের স্বপ্ন বারবার ভঙ্গ হচ্ছে।
কৃষি বিভাগ বলেছে, ফেব্রুয়ারির শুরুতেও ক্ষেতে রয়ে গেছে অনেক আলু। তবে ঘন কুয়াশা ও শীতের তীব্রতায় গাছে মোড়ক লেগে আলুতে পচনের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে লাভের আশায় আলু ক্ষেতে ফেলে রেখে ঝুঁকি নিচ্ছেন চাষিরা। পাশাপাশি লোকসান এড়াতে বিকল্প ফসলে আগ্রহ বাড়ছে তাদের। এতে প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর জমির আলুর আবাদ কমছে।
উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ বগুড়া ও জয়পুরহাটের বিভিন্ন আলুর হাট ঘুরে এবং ক্ষেত দেখে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন: চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি আলুর, রপ্তানিতে সমাধান খুঁজছে সরকার
বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) মহাস্থান হাটে দেখা যায়, প্রতি কেজি সাদা গ্র্যানুলা আলু (হল্যান্ড) ১২-১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা কৃষক পর্যায়ে ১০ টাকা।
কৃষকদের দাবি, নতুন আলুর এ দরে খরচও উঠছে না। তবে পাইকাররা বলছেন, শিগগির আবহাওয়া ভালো না হলে দাম আরও কমতে পারে।
মহাস্থান হাটে আলু বিক্রি করতে আসা কৃষক ওবায়েদ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আজ দাম পেলেও কাল পড়ে যাচ্ছে। তিনদিনের ব্যবধানে মণে ৫০০-৬০০ টাকা কমেছে। হাটে প্রকারভেদে লাল আলু (রোমানা-পাকড়ি) ৭০০-৭২০, সাদা গ্র্যানুলা ৫০০-৫২০, কার্ডিনাল ৬০০-৬২০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। হাটে ৪২ কেজিতে এক মণ ধরা হয়।’
পাইকাররা বলছেন, আলুর বর্তমান পড়তি দাম বেশিদিন থাকবে না। বেশি দামের আশায় অনেকে ক্ষেত থেকে আলু তোলেননি। তারা বড় ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। আবহাওয়া পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে এবং পুরোদমে আলু বাজারে উঠলে দাম আরও পড়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন: অনুকূল আবহাওয়া, আলুর উচ্চ ফলনের আশা
বগুড়ার শিবগঞ্জ, সোনাতলা, ধুনট ও শেরপুর উপজেলায় ক্ষেতে এখনো গাছ সতেজ। জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি, ক্ষেতলাল, কালাই ও আক্কেলপুর উপজেলার অবস্থাও একই।
কৃষি বিভাগ আলুর আবাদে ‘বাম্পার ফলন’দাবি করলেও কৃষকদের ভাষ্য, দাম ভালো না পাওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা। আলুর বদলে গম, ভুট্টা, সরিষাসহ বিকল্প ফসলে ঝুঁকছেন অনেকে।
বগুড়া, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা নিয়ে গঠিত বগুড়া কৃষি অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৭ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে ২২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৮৬ টন আলুর উৎপাদন হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে এক লাখ দুই হাজার ৭৫৫ হেক্টর জমি থেকে ২২ লাখ ১১ হাজার ৮৫৫ টন আলু পাওয়া যায়। অর্থাৎ ৩২ হাজার টন কম আলু উৎপাদন হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছর শুধু বগুড়ায় ৫৮ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে আলুচাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছর বগুড়া কৃষি অঞ্চলের আওতাভুক্ত চার জেলায় এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এক লাখ দুই হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমি। এর মধ্যে বগুড়ায় ৫৮ হাজার ৫২৫, জয়পুরহাটে ৪০ হাজার ৩১৫, সিরাজগঞ্জে ২ হাজার ৯৫৫ ও পাবনায় ৫৬০ হেক্টর জমি।
আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কায় আলু পাঠানোর কথা ভাবছে বাংলাদেশ
তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষকের ভাষ্য, কৃষি বিভাগের এ তথ্য অনুমাননির্ভর। প্রকৃতপক্ষে আলুর আবাদ অনেক কম। দাম না পাওয়ায় প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর করে আলুর আবাদ কমছে। স্বাভাবিক কারণে ফলনও কম হবে।
কৃষকরা বলছেন, ভুট্টা, গম, সরিষার মতো দানাদার শস্যের দাম অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে। আলুর চেয়ে তুলনামূলক কম পরিশ্রম ও খরচ হওয়ায় মুনাফার আশায় চাষিরা এসব ফসলে ঝুঁকছেন।
শেরপুর উপজেলার মির্জাপুরের কৃষক আরিফুল, আমির আলী ও সবুজ মিয়া বলেন, সয়াবিন তেলের লাগামহীন দামের কারণে চাহিদা বেড়েছে সরিষার। দামও ভালো পাওয়ায় আলু বাদ দিয়ে অনেকে সরিষা আবাদ করছেন।
শেরপুরের সাধুবাড়ির আলুচাষি আইয়ুব আলী বলেন, ‘সাদা আলু হাটে নিলে দাম পাবো ৪০০ টাকা মণ। এতে খরচের টাকা ওঠাই কষ্টকর। ভাগ্যের সঙ্গে বাজি ধরে আবাদ করি। দাম ভালো হলে লাভ, না হলে লোকসান।’
আরও পড়ুন: আলু চাষে বাড়ছে খরচ, চড়া দামে কিনতে হচ্ছে সার-বীজ
প্রতি বছর আলুচাষ কমছে বলে স্বীকার করেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বগুড়ার উপপরিচালক জাকির হোসেন।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আলুর বাজার অস্থিতিশীল, কখনো কমে কখনো বাড়ে। এজন্য আলুচাষে কৃষকের ঝুঁকি বাড়ছে। অন্যান্য দানাদার শস্যের কদর বেড়ে যাওয়ায় সেদিকে ঝুঁকছেন তারা।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপপরিচালক মতলবুর রহমান জানান, বগুড়া অঞ্চলে আলুর বিপরীতে অন্য ফসল চাষ বাড়ছে। গম, ভুট্টা ও সরিষা চাষে লাভ বেশি।
বেড়েছে হিমাগার খরচ
বগুড়া ও জয়পুরহাট মিলে বৃহত্তর বগুড়া জেলা কোল্ড স্টোরেজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। হিমাগারের মালিকরা জানান, বগুড়ায় ৩৬ ও জয়পুরহাটে ২০টি হিমাগার রয়েছে। বগুড়ার হিমাগারে তিন লাখ ১৭ হাজার ও জয়পুরহাটে এক লাখ ৮৫ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। এসব হিমাগারে এখন বস্তায় ৫০ কেজির বেশি আলু রাখা যায় না। ভাড়া বাড়িয়ে কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: হিলিতে আলুচাষে কৃষকের মুখে হাসি নেই
বৃহত্তর বগুড়া জেলা কোল্ড স্টোরেজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অ্যাসোসিয়েশন রেট পাঁচ টাকা করেছে। গত বছর কোল্ড স্টোরেজের বিদ্যুৎ বিল ছিল ২৫-৩০ লাখ টাকা। এখন তা ৮০-৯০ লাখে ঠেকেছে। ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করি। প্রতি বছর আলুর দাম নিম্নমুখী হওয়ায় হিমাগার মালিক, আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা হতাশায় দিন পার করছেন।’
এসআর/এএইচ/এমএস