প্রথম দিনেই জমজমাট দিনাজপুরের ঘোড়ার হাট
রাস্তার রাজা, বিজলী রানী, রাস্তার পাগল, রংবাজ, পারলে ঠেকাও, কাজলি, তাজিয়া, কুমার রাজা, বিজলী, বাহাদুর এমন বাহারি সব নামের ঘোড়া এখন দিনাজপুরের চেরাডাঙ্গী মেলায়। বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেলায় এসেছেন ঘোড়া ব্যবসায়ীরা। প্রতি বছর ২৩ মাঘ মেলার উদ্বোধন হলেও এবার মেলার উদ্বোধন হলো দুই দিন আগে ২১শে মাঘ। মেলা চলবে এক মাস।
জনশ্রুতি আছে, ৭৬ বছর আগে শুরু হওয়া এই মেলায় আগে গরু, ছাগল, ঘোড়া, মহিষসহ উট ও দুম্বার ব্যাপক আমদানি হতো। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেগুলো আমদানি করা হতো। কালের বিবর্তনে ওইসব প্রাণীর পরিবর্তে জায়গা করে নেয় গরু, মহিষ এবং ঘোড়া। এছাড়া বিনোদনের জন্য যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ এবং সংসারের যাবতীয় আসবাবপত্র কাঠ, স্টিল ও প্লাস্টিকের ফার্নিচার, মিষ্টান্ন, মসলা, জুতা ও কাপড়সহ এমন কোনো জিনিস নেই যা এ মেলায় বিক্রি হয় না। প্রায় আড়াই কিলোমিটার বর্গাকার এ মেলা ঘিরে এলাকার প্রায় ২০ গ্রামে চলে মেজবান আয়োজনও।
কিন্তু এই মেলায় প্রায় দেড় দশক থেকে গরু মহিষ ও ছাগলেরও আমদানি নেই। প্রথমদিন থেকেই মেলায় ঘোড়ার আমদানি হয় চোখে পড়ার মতো। মেলা শুরুর একদিন আগে থেকেই ঘোড়া ব্যবসায়ীরা তাদের ঘোড়া নিয়ে আসেন মেলায়।
শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলা থেকে ঘোড়া নিয়ে আসা মো. আব্দুল জলিল প্রামানিকের সঙ্গে।
তিনি জানান, তিনি ৩টি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন। তার ঘোড়ার নাম রাস্তার রাজা, বিজলী রানী ও রাস্তার পাগল। তার ঘোড়া তিনটি অত্যন্ত দ্রুত গতিসম্পন্ন। একেকটি ঘোড়ার দাম হাঁকছেন দেড় লাখ টাকা। প্রথম দিন মানুষ আসছে, দেখছে। দাম বলছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দাম না বলায় তিনি ঘোড়া বিক্রি করতে পারেননি।
বগুড়া সদর উপজেলা থেকে এসেছেন আজগর আলী। তার ঘোড়া অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছোটে। এজন্য ঘোড়ার নাম দিয়েছেন ‘পারলে ঠেকাও’। এলাকায় তার ঘোড়াকে সবাই ‘পারলে ঠেকাও’ বলেই ডাকে। তার ঘোড়ার দাম এক লাখ টাকা। ৮০ হাজার টাকা হলে ঘোড়াটি বিক্রি করবেন বলে জানালেন।
দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার শান্তির বাজার থেকে ঘোড়া নিয়ে মেলায় এসেছেন নুর ইসলাম।
তিনি জানান, গত বছর তার ঘোড়ার নাম দিয়েছিলেন ‘কিরণ মালা’। সেটি মহিলা ঘোড়া ছিল। এবার পুরুষ ঘোড়ার নাম দিয়েছেন রংবাজ। ৮০ হাজার টাকা পেলে রংবাজকে বিক্রি করে নতুন ঘোড়া কিনবেন বলে জানান।
দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার তেঘরা জুলিমুদি খানা থেকে দুটি ঘোড়া মেলায় এনেছেন মোহাম্মদ ইসলাম। তার ঘোড়ার নাম বিজলী ও কাজলী। একেকটি ঘোড়ার দাম হাঁকছেন এক লাখ ৮০ হাজার টাকা করে।
একজন ক্রেতা সোয়া লাখ টাকা দাম বললেও শেষ না দেখে বিক্রি করবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ১০ বছর ধরে এ মেলায় ঘোড়া কেনাবেচা করছি। কিন্তু ঘোড়ার দৌড়ের মাঠ না থাকায় খুব সমস্যা হয়। ঘোড়দৌড় ঠিকমতো দেখানো না গেলে বিক্রি করা যায় না।
দিনাজপুর শহরের উপশহর ৮নং ব্লকের বকুল শখের বসে একটি ঘোড়ার বাচ্চা কিনেছেন। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে ভাবছি একটা ঘোড়া কিনব এবং বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের জন্য লালনপালন করবো। কিন্তু হয়ে উঠছিল না। এবার চেরাডাঙ্গী মেলা থেকে ঘোড়ার বাচ্চা কিনলাম। দাম বেশ বেশি।
বিকেলে দিনাজপুর সদরে ৭৬তম ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ চেরাডাঙ্গী মেলার উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি। বাংলাদেশ চেরাডাঙ্গী মেলা কমিটির আয়োজনে কমিটির প্রেসিডেন্ট মিজানুর রহমান মিজানের সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি সাহেদ জামানের সঞ্চালনে বক্তব্য রাখেন দিনাজপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) আব্দুল্লাহ আল মাসুম, দিনাজপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইমদাদ সরকার, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রমিজ আলম, জেলা চাউল কল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন, সাবেক সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম, আউলিয়াপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল, আউলিয়াপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন, সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকারিয়া জাকির।
দিনাজপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভিরুল ইসলাম জানান, মেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এরইমধ্যে বিশেষ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক নজর রাখা হবে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ মেলার ঐতিহ্য ফেরাতে যেন কোনো প্রকার অনিয়ম, অশ্লীলতা না থাকে সে ব্যাপারেও তাদের নজরদারি রয়েছে।
এমদাদুল হক মিলন/এফএ/জেআইএম