ব্যাংক ঋণে ‘ভোগান্তি’, এনজিওতে ঝুঁকছেন হাওরের কৃষক

লিপসন আহমেদ লিপসন আহমেদ , সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৯:৪৬ পিএম, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

অডিও শুনুন

ঋণ নিতে নানা ভোগান্তি এড়াতে ব্যাংকবিমুখ হচ্ছেন সুনামগঞ্জের কৃষকরা। অপেক্ষাকৃত সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ায় বেসরকারি সংস্থামুখী (এনজিও) হচ্ছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে দুই হাজার কৃষককে ২৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয়েছে। তবে এনজিও থেকে নেওয়া এ ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। কৃষকরা বলছেন, মূলত ভোগান্তি এড়াতেই এনজিওর দিকে ঝুঁকছেন তারা।

বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জে ধানের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। গতবছরের বন্যায় ঘরবাড়ি ও গোলার ধান ভেসে যাওয়ায় এবছর ধান রোপণের পাশাপাশি ঘরবাড়িও মেরামত করতে হচ্ছে কৃষকদের। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।

সরকারি পর্যায়ে ব্যাংকগুলোতে ঋণ সহায়তাসহ নানা প্রণোদনা প্যাকেজ রয়েছে কৃষকদের জন্য। কিন্তু অতিরিক্ত হয়রানি ও অধিক পরিমাণের নিয়মকানুন থাকায় ব্যাংকের ঋণ না নিয়ে জরুরিভিত্তিতে অর্থের জন্য তারা ছুটছেন এনজিওর দুয়ারে। পরে উৎপাদিত ধানের লাভের টাকা দিয়ে চড়া সুদে সেই ঋণ পরিশোধ করেন কৃষকরা।

হাওরে গিয়ে দেখা যায়, প্রচণ্ড শীতে ঠান্ডা কাদাপানিতে খালি পায়ে লাঙল দিয়ে হালচাষ করছেন কৃষকরা। সেখানে কথা হয় সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার কৃষক আব্দুল খালেক ও চালেক মিয়ার সঙ্গে। তারা জানান, টাকার অভাবে পাওয়ার টিলার কিনতে পারছেন না। তাই ১২ কেয়ার (একর) জমিতে লাঙল দিয়ে হালচাষ করছেন দুই ভাই।

আরও পড়ুন: প্রশিক্ষণ ছাড়া হাঁস পালনে বিপাকে সুনামগঞ্জের খামারি

আরেক কৃষক আব্দুল মতিন। এবছর সাত একর জমিতে বোরো ধান করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বোরো ধান উৎপাদনে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। আমাদের মতো কৃষকদের জন্য সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা আছে কি না জানা নেই।’

সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার কৃষকদের মধ্যে লেখাপড়া জানা ব্যক্তির সংখ্যা কম। জমির কাগজপত্র সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। ফলে সরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে হাওরপাড়ের কৃষকরা যোগাযোগ করলে তারা কোনো সহযোগিতা পান না বলে অভিযোগ। কখনো কখনো দালালদের খপ্পরে পড়ে চরম বেকায়দায় পড়তে হয় তাদের।

বাধ্য হয়ে চড়া সুদে গ্রামের মহাজন ও এনজিওগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেন কৃষকরা। যা পরিশোধ করতে উৎপাদিত ফসলের বড় একটা অংশ চলে যায়। ফলে সরকারিভাবে কৃষি ঋণ না পাওয়ায় হতাশায় আছেন সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলার কৃষকরা।

আরও পড়ুন: গ্রামের নাম ৯৯৯!

হাওরের কৃষক রাজু মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংকে যাওয়ার চেয়ে না যাওয়া ভালো। কারণ ব্যাংকে গেলে টাকা তো পাই-ই না বরং আমাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়।’

ব্যাংক ঋণে ‘ভোগান্তি’, এনজিওতে ঝুঁকছেন হাওরের কৃষক

কৃষক তৈয়বুর মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঋণ নিতে গেলে ব্যাংক আমাদের হয়রানি করে। সেজন্য আমরা মহাজন কিংবা এনজিওগুলোর কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে বোরো ধান করি।’

‘গতবছরের বন্যায় ফসল-গোলার ধান ভেসে গেছে। ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। এবার বোরো ধানের পাশাপাশি ঘরবাড়িও মেরামত করতে হবে। তবে এত টাকা কীভাবে জোগাড় করবো তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’

সুনামগঞ্জ কৃষি ব্যাংকের তথ্যমতে, এবছর বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকদের ঋণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ কোটি টাকা। এরই মধ্যে দুই হাজার কৃষককে ২৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকাও পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে।

ব্যাংক ঋণে ‘ভোগান্তি’, এনজিওতে ঝুঁকছেন হাওরের কৃষক

জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ কৃষি ব্যাংকের মুখ্য আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান শহীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা খুব সহজ শর্তে কৃষকদের ঋণ দিয়ে থাকি। কৃষকের ভোটার আইডি, ছবি আর যে জায়গায় সে চাষাবাদ করবে সেই জায়গায় খতিয়ান ব্যাংকে জমা দিলে তিন দিনের ভেতরে আমরা কৃষকদের ঋণ দিয়ে দিই।’

আরও পড়ুন: বন্যায় বই-খাতা ভেসে যাওয়া রীমা পেল জিপিএ-৫

তবে এর ঠিক উল্টো চিত্র এনজিওগুলোতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে ব্র্যাক, শক্তি ফাউন্ডেশন, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, ব্যুরো বাংলাদেশ, গ্রামীণ ব্যাংকসহ ২৯ এনজিওর কার্যক্রম রয়েছে। কৃষকরা বলছেন, ব্যাংকের তুলনায় এনজিও থেকে ঋণ পাওয়া সহজ। তবে তাদের সুদের হার বেশি। তারপরও বিভিন্ন ঝামেলা এড়াতে এসব এনজিও থেকেই ঋণ নেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এনজিও কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, স্বামী-স্ত্রীর ছবি দিয়ে কিছু শর্ত পূরণ করলেই আমরা ঋণ দিয়ে থাকি। এবছর আনুমানিক প্রায় ৫০ কোটি টাকার মতো ঋণ বিতরণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ব্যাংক ঋণে ‘ভোগান্তি’, এনজিওতে ঝুঁকছেন হাওরের কৃষক

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সুনামগঞ্জ জেলায় তিন লাখ ৭৮ হাজার কৃষক পরিবার রয়েছে। এরই মধ্যে ৬৮ হাজার কৃষকের তালিকা তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।

তথ্যমতে, এবছর পাঁচ লাখ কৃষক বোরো ধান করছেন। দুই লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হবে। যা থেকে ধান হবে ১৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। আর চাল উৎপাদন হবে ৯ লাখ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, কৃষকরা যাতে হয়রানি মুক্ত হয়ে কৃষিঋণ পেতে পারেন সেজন্য আমরা মাঠ পর্যায়ে সভা, সেমিনার করে তাদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। কোনো কৃষক যদি ব্যাংকে গিয়ে হয়রানির শিকার হন তাহলে অবশ্যই কৃষি অফিস তাদের সহযোগিতা করবে।

এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।