জাতীয় মহাসড়কে যুক্ত হলো বান্দরবান, বদলে যাবে পর্যটন
নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়েছে বান্দরবান-কেরানীহাট মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের কাজ। এরমাধ্যমে জাতীয় মহাসড়কে যুক্ত হয়েছে পর্যটন নগরী বান্দরবান।
২৬৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে সেনাবাহিনীর ২০ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন। শিগগির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সড়কটির উদ্বোধন করবেন।
বান্দরবানের রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও সদর উপজেলার বাসিন্দাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম কেরানীহাট-বান্দরবান সড়ক। পর্যটন নগরী হওয়ায় প্রতিদিন স্থানীয়সহ কয়েক হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক যাতায়াতের জন্য সড়কটি ব্যবহার করেন। সড়কটি উঁচু-নিচুসহ প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই সরু ছিল। এছাড়া বর্ষাকালে জলাবদ্ধতাসহ যাতায়াতে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো। ফলে প্রায় ঘটতো দুর্ঘটনা। তবে এখন প্রশস্ত হওয়ায় সড়কটি দিয়ে চলাচলকারীদের যাতায়াতে ঝুঁকি কমার পাশাপাশি কমেছে সময়ও।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর কেরানীহাট-বান্দরবান জাতীয় মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটির কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর। সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনস্থ ২০ ইঞ্জিনিয়ার্স কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রকল্পের মেয়াদ পূর্তির আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ২১টি ব্রিজ, ১৫টি কালভার্ট, ২১ কিলোমিটার ড্রেনেজ নিষ্কাশন অবকাঠামো তৈরিসহ সড়ক প্রশস্তকরণ কাজের গুনগত মান বজায় রেখে কাজ শেষ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
বান্দরবান সুয়ালক এলাকার বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, বান্দরবান-কেরানীহাট জাতীয় মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। খুব সুন্দর ও প্রশস্ত নতুন এ সড়কটি দেখে স্থানীয় ও পর্যটকরা খুবই বিমোহিত। আগে এ সড়কের অনেক স্থানে ভাঙা ছিল ও উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা ছিল। কিন্তু এখন এ সড়কটি অনেক প্রশস্ত হয়েছে।
বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের বাসচালক মো. জসীম বলেন, বান্দরবান সড়কে এখন বাস চালানো আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে। সড়কের মান ভালো হয়েছে ও বেশিরভাগ স্থানে সড়কের পাশে সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রোড ডিভাইডার থাকায় দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।
কেরানীহাট-বান্দরবান জাতীয় মহাসড়ক উন্নয়নকাজের প্রকল্প কর্মকর্তা (২০ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন) মেজর মো. শাহ সাদমান রহমান বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সড়কটি মহাসড়ক মানে উন্নীত করা, বিদ্যমান সরু, পুরাতন ও জরাজীর্ণ সেতু এবং কালভার্টগুলো পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে একটি নিরাপদ, টেকসই এবং ব্যয় সাশ্রয়ী সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা।
তিনি বলেন, ২৬৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের কাজটি সম্পন্ন করেছে সেনাবাহিনী। আগে এই সড়কটির গড় প্রশস্থতা ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৫৮ মিটার। এছাড়া বিভিন্ন যানবাহন এবং পণ্যবাহী বাহনের চাপ অনুযায়ী সড়কটির প্রশস্ততা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রশস্থতা কম থাকায় ঝুঁকি নিয়ে উভয়মুখী যানবাহন চলাচল করতে হতো। ফলে সড়কটিতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটতো। এছাড়া সড়কটি নিচু হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে রাস্তার বিভিন্ন অংশ তলিয়ে যেত। এতে করে বান্দরবানের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো। পরে প্রকল্পটির কাজ পেয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই সেটি শেষ করে সেনাবাহিনী।
বান্দরবান সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কটি ১৮ ফুট থেকে ২৪ ফুট প্রশস্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় হয়েছে ২৬৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। প্রকল্পে কাজের মধ্যে রয়েছে ২১টি ব্রিজ, ১৫টি কালভার্ট, তিনটি যাত্রী ছাউনি, ২১ কিলোমিটার ড্রেনেজ নিষ্কাশন অবকাঠামো, ৬০২ মিটার রিজিড পেভমেন্ট ওয়ার্ক ও সড়ক বিভাগের একটি পরিদর্শন বাংলো নির্মাণ। এছাড়া সম্পূর্ণ ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার রাস্তার গড় প্রশস্থতা ৫ দশমিক ৪৮ মিটার থেকে ৭ দশমিক ৩ মিটারে উন্নীত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এছাড়া সড়ক রক্ষায় ১ হাজার ২১০ মিটার আরসিসি প্যালাসাইডিং কাজসহ পাহাড়ের ধস প্রতিরোধের জন্য ১ হাজার ২৬৩ মিটার রক্ষাপ্রদ কাজ, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সোজাকরণ, সুপার এলিভিয়েশন সংশোধন, রোড জিওমেট্রি সংশোধন, নিরাপত্তামূলক গার্ড রেইল, গাইড পোস্ট, সাইন পোস্ট ও অবজারভেটরি মিররের ব্যবহারে সড়কটিতে যেমন দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে তেমনি নিরাপদ সড়ক হিসেবে পর্যটন নগরী বান্দরবানকে সুখ্যাতি এনে দেওয়ার পাশাপাশি পর্যটকরা দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।
প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আরও বলেন, বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কটিকে মহাসড়ক মানে উন্নীত করার মাধ্যমে এই এলাকার জনসাধারণের জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হলো। দুর্গম বান্দরবানবাসী তাদের নিজস্ব উৎপাদিত কৃষিপণ্য কম খরচে এবং অল্প সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করতে পারবেন। এতে করে এলাকার কৃষকদের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে বান্দরবান অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে।
শিগগির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সড়কটির উদ্বোধন করবেন বলেও জানান তিনি।
নয়ন চক্রবর্তী/এমআরআর/জিকেএস