বগুড়ার দুই আসনে উপ-নির্বাচন
মাঠে নেই বিএনপি, আসন কবজায় নিতে মরিয়া আওয়ামী লীগ
বিএনপির ছেড়ে দেওয়া বগুড়ার দুটি আসনে উপ-নির্বাচন বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি)। এরই মধ্যে প্রচারণা শেষ করেছেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তবে ভোট নিয়ে অনাগ্রহের কথা জানিয়েছেন ভোটাররা।
এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে নৌকায় ভোট না দিলে কেন্দ্রে আসা যাবে না মর্মে হুমকি দেওয়া হয়েছে ভোটারদের। এতে নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া নিয়ে সংশয়ে ভোটাররা।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ভাষ্য, ভোটার উপস্থিতি কম হলে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ কারণে তারা চাচ্ছেন উপস্থিতি কম হোক।
তবে সব ধরনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেছেন, পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভোটের দিন পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। পাশাপাশি আগাম কোনো ভোটার বা প্রার্থীকে ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়ার ঘটনার সত্যতা মিললে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।
আরও পড়ুন: ভোটগ্রহণে প্রস্তুত বগুড়া, বন্ধ প্রচারণা
পুলিশ সুপার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বগুড়ার দুটি আসনের ২৫৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৫৮টিকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে বগুড়া-৬ সদর আসনে ১৪৩টির মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৭৯টি। আর বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনেও মোট ১১২টির মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ৭৯টি।
বর্তমান সরকারের মেয়াদে বগুড়া-৬ সদর আসনে তৃতীয়বার আর বগুড়া-৪ আসনে ভোট হচ্ছে দ্বিতীয়বার। মাঠে বিএনপি নেই তাই ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই—এমনটি দাবি করেছেন বিএনপির নেতারা।
বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর হেনা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমারা প্রতিটি নেতাকর্মীকে নিষেধ করেছি ভোটকেন্দ্রে না যেতে। এমনকী ভোটের কোনোরকম কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে সহযোগিতা করার ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছে। এরপরও কেউ বিএনপির বর্জন করা ভোটে গেলে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।’
হেনা বলেন, ‘যেহেতু বগুড়াকে বিএনপির ঘাঁটি বলা হয়, সে কারণে আমরা মনে করছি সাধারণ মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবে না। এটা প্রহসনের ভোট। আমরা মনে করছি এ ভোটে ১০ পারসেন্ট ভোটারকে উপস্থিত করাও কষ্টকর হবে।’
আরও পড়ুন: নগদে ওমর, মামলায় মান্নান, ঋণে রিপু
অন্যদিকে দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা সদর থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি সরকার বাদল বলেন, ‘বগুড়া সদর আসনটি বিএনপির। এটা যে কোনো আঙ্গিকেই হোক না কেন বিএনপির হাতেই থাকা উচিত। আমি সে কারণে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট করছি। আমি মনে করি প্রশাসন নির্বিঘ্নে ভোটদানের ব্যবস্থা করলে অনেক বিএনপি নেতাকর্মীই ভোটের মাঠে আসবেন, ভোট দেবেন।’
এদিকে বগুড়া সদর আসনটি দীর্ঘদিন পর নিজেদের দখলে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। এ কারণে তারা মাঠে যেমন সক্রিয়, তেমনি ভোটারদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন এমন অভিযোগও মিলেছে।
সম্প্রতি বগুড়া সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল ইসলাম রাজের একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে কর্মী সমাবেশে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে রাজকে বলতে শোনা যায়, ‘যারা নৌকায় ভোট দিবে না, তারা ভোটকেন্দ্রের আশেপাশেও আসবে না। কেন্দ্র থাকবে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গদলের নিয়ন্ত্রণে। এজন্য সমস্ত ব্যবস্থা করতে হবে।’
মাহফুজুল ইসলাম রাজ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বক্তব্যটি যেভাবে ভাইরাল হয়েছে সেভাবে নির্দেশনা দেইনি। এটি ছিল একটা কথার কথা। সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগকে ভালোবেসেই কেন্দ্রে আসবে, ভোট দেবে।’
আরও পড়ুন: শুধু সেলফি তুলেন না, একতারা মার্কায় ভোটটা দিয়েন: হিরো আলম
গত ১৯ জানুয়ারি বগুড়া-৬ (সদর) আসনের প্রচারণা চলাকালে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা আরিফ মন্ডল ছুরিকাহত হন। ঘটনার সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক প্রতীকের আব্দুল মান্নান আকন্দ তিনটি মিনি ট্রাকে করে দুই শতাধিক কর্মী-সমর্থক নিয়ে পথসভা করছিলেন। নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনায় ছুরিকাহতের ঘটনা ঘটে।
শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নান আকন্দ সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘এ মুহূর্তে নৌকা প্রার্থীর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আমি। এ কারণে নৌকার পক্ষ নিয়ে আমার কর্মীদের ওপরে প্রতিনিয়ত হামলা ও হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরআগে বগুড়া জেলা পরিষদ নির্বাচনেও আমি প্রার্থী ছিলাম। সে সময় আমার বিজয় নিশ্চিত জেনে একটি মিথ্যা মামলায় কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। এবার আমি বাইরে থাকলেও নির্বিঘ্নে প্রচারণার কাজ করতে দিচ্ছে না। নির্বাচনী গাড়ি আটকে দেওয়া হচ্ছে। পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। প্রশাসন আমার কোনো অভিযোগই আমলে নিচ্ছে না। আমি মনে করছি অনেক ভোটার ভয়েই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসবে না।’
জানতে চাইলে নৌকার প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগিবুল আহসান রিপু বলেন, ‘আমরা কোনো প্রার্থীকেই বাধা দিচ্ছি না। ভোট হলো গণতান্ত্রিক অধিকার। জনগণ আমাদেরকে ভালোবেসে ভোট দেবে। কেন্দ্রেও বিপুল পরিমাণ ভোটার উপস্থিত হবে।’
আরও পড়ুন: আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নৌকার পক্ষে যুবলীগের মোটরসাইকেল মহড়া-
বৃহস্পতিবার নৌকার পক্ষে এক নির্বাচনী সভায় প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘বগুড়ার উন্নয়ন চাইলে নৌকায় ভোট দিতে হবে। আমরা আশা করছি ৬০ পারসেন্টের বেশি ভোটগ্রহণ হবে।’
সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের অংশগ্রহণ না থাকলেও নৌকার বিজয়ে গলার কাঁটা হিসেবে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান আকন্দ (ট্রাক)। তিনি বিগত বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকার প্রার্থীর চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি জেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সামান্য ব্যবধানে হেরে যান। তাই তাকে নিয়ে চিন্তায় রয়েছে আওয়ামী লীগ।
নন্দীগ্রাম উপজেলা বাসস্ট্যান্ড বাজারের একটি চায়ের দোকানে কথা হয় স্থানীয় কৃষক কবির খানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব দল ভোটত গেলি হামরাও ভোট দিবার যামো। বিএনপি বাদ দিয়্যা ভোট হলে দিবার যামু না।’
কলেজপাড়ার সবুজ মিয়া অভিযোগ করে বলেন, নির্দিষ্ট একটি মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে পরিবার থেকে কেউই কেন্দ্রে যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বগুড়া শহরের মাটিডালি, শেখেরকোলা এলাকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন এ প্রতিবেদক। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে তারা নির্বাচনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আরও পড়ুন: সুযোগ পেলে মন্ত্রীও হবো: হিরো আলম
তবে গোকুল এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, ‘নৌকায় ভোট না দিলে নাকি কেন্দ্রে যাওয়া যাবে না। আমরা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ভোট দিয়ে আবার কোনো ফ্যাসাদে পড়ি সেই চিন্তা করছি।’
একই এলাকার ফৌজিয়া খাতুন নামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘ইচ্চে ছিল কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার। কিন্তুু পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ভোটের দিন সকালে অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেবো।’
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্রার্থীরা যাতে আচরণবিধি মেনে প্রচারণা চালান তা পর্যবেক্ষণের জন্য দুই নির্বাচনী এলাকায় ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন। ভোটারদের কেন্দ্রে না আসার বা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তারপরও আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বগুড়া-৬ (সদর) আসনে এবার ভোটার চার লাখ ১০ হাজার। আর বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের ভোটার তিন লাখ ২৮ হাজার।
এ দুই আসনের উপ-নির্বাচনে মোট ১৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে বগুড়া-৪ আসনে ছয়জন এবং বগুড়া-৬ আসনে ১১ জন প্রার্থী আছেন।
বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্তে বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মো. সিরাজ ও বগুড়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোশারফ হোসেন গত ১১ ডিসেম্বর স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করেন। এতে আসন দুটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। পরে ১ ফেব্রুয়ারি ইভিএমে ভোটগ্রহণের জন্য তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এসআর/জিকেএস