মাদারীপুর সদর হাসপাতাল

নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ গেলে ভরসা মোমবাতি

আয়শা সিদ্দিকা আকাশী
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী আয়শা সিদ্দিকা আকাশী , জেলা প্রতিনিধি মাদারীপুর
প্রকাশিত: ০৬:৪৪ পিএম, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

মাদারীপুর সদর হাসপাতালের পুরাতন ভবনের পশ্চিম দিকের একটি অংশে ছাদ ও দেওয়ালের পলেস্তারা পড়ে নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ টাকার ডেন্টাল ও চক্ষু ইউনিটের যন্ত্রপাতি। এর মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে হাসপাতালের কার্যক্রম চালাতে হয়। তবে খুব শিগগির এসব সমস্যার সমাধান করা হবে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

১৫ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টা। সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালে বিদ্যুৎ নেই। টিকিট কাউন্টারে মোমবাতি জ্বালিয়ে স্টাফরা কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতিই তাদের সম্বল। দিনের বেলায়ও মোমবাতি জ্বালিয়ে কার্যক্রম চালাতে হয়। নতুন ভবনে অত্যাধুনিক জেনারেটর থাকলেও সংযোগের অভাবে পুরাতন ভবনের জন্য কোনো কাজেই আসছে না। পুরোনো ভবনে ছোট ছোট কয়েকটি আইপিএস থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলে রোগীদের অন্ধকারে থাকতে হয়।

হাসপাতালে এক্সরে করতে আসা মাদারীপুরের রাজারচর এলাকার জয়নাল মাতুব্বরের স্ত্রী আসমতি বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোমরে ব্যথা নিয়ে এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছি। ডাক্তার এক্সরে করতে বলেছেন। কিন্তু প্রায় এক ঘণ্টা হলো বসে আছি, কারেন্ট নেই। কখন কারেন্ট আসবে, তাও জানি না। কারেন্ট আসলে তবেই পরীক্ষা করতে পারবো।’

আরও পড়ুন: এক ঘরে তিন প্রজন্মের ঠাসাঠাসি করে বসবাস

শহরের পুরানবাজার এলাকার সিমা বেগম বলেন, ‘হাতের এক্সরে করতে হবে। অথচ কারেন্ট নেই। হাসপাতালে জেনারেটর থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি।’

হাসপাতালের নিচতলায় ভর্তি এক রোগীর অভিভাবক কালকিনি উপজেলার ধুলগাঁও গ্রামের পারভীন বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ের বাচ্চা হবে, তাই হাসপাতালে ভর্তি করেছি। রাতে অনেক সময় কারেন্ট চলে যায়। তখন অন্ধকারে আমাদের অনেক কষ্ট হয়। তাই দিনেই বেলায় মোমবাতি ও দিয়াশলাই কিনে এনেছি। যাতে রাতের বেলায় আমাদের সমস্যায় পড়তে না হয়।’

টিকিট কাউন্টারে বসেছিলেন আজাদ শরীফ। বিদ্যুৎ না থাকায় মোমবাতি জ্বালিয়ে কাজ করতে দেখা যায় তাকে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কী করবো? কারেন্ট নেই। অন্ধকার। তাই মোমবাতি জ্বালিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। প্রতিদিনই রোগীর চাপ থাকে। ৪০০-৬০০ পর্যন্ত টিকিট নেন রোগীরা। তাই বিদ্যুৎ না থাকলেও আমাদের কাজ করতে হয়। বসে থাকার কোনো উপায় নেই।’

হাসপাতালের পুরোনো দ্বিতীয় তলা ভবনের পশ্চিম পাশের একটি কক্ষে বসে রোগী দেখছিলেন ডা. সঞ্জয় মন্ডল। দেখা গেল, সেখানে ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। তার পেছনের রুমে কয়েক লাখ টাকার ডেন্টালের যন্ত্রপাতি। সেই রুমে আরও বেশি পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে।

আরও পড়ুন: শীতের পিঠা বিক্রি করে দৈনিক আয় ২০০০-৩৫০০ টাকা

ডেন্টাল ও চক্ষু ইউনিটের প্রায় ১০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি রয়েছে। অথচ সেই অংশে প্রায় এক বছর ধরে ছাদ ও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। পলেস্তারা পড়ে দামি মেশিনগুলো নষ্ট হচ্ছে।

সেবা নিতে আসা হাওলা গ্রামের জরিনা বেগম বলেন, ‘আমার দাঁতে সমস্যা। তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছি। কিন্তু ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। ভয়ে ভয়ে এখানে বসে চিকিৎসা নিচ্ছি।’



আরেক রোগী আমেনা বেগম জাগো নিইজকে বলেন, ‘আমার ছেলের পায়ে সমস্যা। ডাক্তার দেখাবো। তাই এখানে বসে আছি। ওপরের দিকে তাকালে ভয় লাগে।’

মাদারীপুর সদর হাসপাতালের ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট ও ইনচার্জ সঞ্জয় মন্ডল বলেন, ‘এখানে প্রায় ৬-৭ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি আছে। এগুলো সরানোর জন্য বারবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জানানো হয়েছে। আমরা ইচ্ছা করলেই সরাতে পারি না। এটা সরাতে ইঞ্জিনিয়ার লাগবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর সদর হাসপাতালে অ্যানালগ ও ডিজিটাল দুটি এক্সরে মেশিন আছে। ডিজিটাল মেশিনের একটি যন্ত্র কয়েক মাস ধরে নষ্ট থাকায় রোগীদের বুকের এক্সরে করানো বন্ধ আছে। যন্ত্রটি প্রায় দেড় মাস আগে মেরামতের জন্য ঢাকায় পাঠানো হলেও এখনো ঠিক হয়নি।

আরও পড়ুন: ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষে ভাগ্য বদল কৃষকের

এক্সরে বিভাগের দায়িত্বে থাকা উত্তম কুমার মজুমদার বলেন, ‘শুধু বুকের এক্সরে বাদে সবগুলোই এখানে করানো হয়। নষ্ট যন্ত্রটি মেরামতের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় মাদারীপুর সদর হাসপাতালের নতুন ভবন। ভবন নির্মাণ শেষে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এর মধ্যে সিটি স্ক্যান মেশিন কেনা হয় প্রায় তিন কোটি টাকা দিয়ে। এছাড়া ডিজিটাল এক্সরে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন, ১০টি কার্ডিয়াক মনিটর, আধুনিক জেনারেটরসহ কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি রয়েছে হাসপাতালের নতুন ভবনে। তবে ব্যবহার না করায় অযত্ন-অবহেলায় বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

মাদারীপুরের চরমুগরিয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র সিহাব মাহমুদ বলেন, মাদারীপুর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দারবালী মৌজার ওপর দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের নতুন সাততলা ভবন (২৫০ শয্যা)। সেখানে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি থাকলেও কোনো কাজেই আসছে না।

আরও পড়ুন: কোনো কাজ নাই, মেট্রোরেলে চড়তে এসেছি

জানতে চাইলে মাদারীপুর সদর হাসপাতালের সিভিল সার্জন ডা. মুনীর আহমদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ছাদ ও দেওয়ালের রিপেয়ারিং কাজ চলছে। ডেন্টাল ও চক্ষু ইউনিটের সব যন্ত্রপাতি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন ভবনে নেওয়া হবে। নতুন ভবনের নিচতলা ও দোতলায় ৫০ শয্যাসহ কার্যক্রম শুরু করা হবে। দ্বিতীয় তলার ওপরে কেউ যেন উঠতে না পারেন সেজন্য একটি গেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটি করা হলেই আমরা নতুন ভবনের আংশিক কার্যক্রম চালু করতে পারবো।

বিদ্যুৎ সমস্যার বিষয়ে বলেন, বিদ্যুৎ চলে গেলে এখানে অপারেশন রুমসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রুমে আইপিএস দিয়ে কার্যক্রম চালানো হয়। তবে নতুন ভবনে অত্যাধুনিক জেনারেটর মেশিন আছে। তা দিয়ে পুরাতন ভবনের কার্যক্রম চালানো সম্ভব। আমি এ নিয়ে টেকনোলজিস্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন শুধু একটি দুপয়েন্টের মেশিন বসাতে হবে। মেশিনটির দাম ৪২ লাখ টাকা। মেশিনটির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। সেটি হলে পুরোনো ভবনের পুরো অংশও জেনারেটরের আওতায় চলে আসবে।

এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।