নানা সংকটে শেরপুরের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো, সেবাবঞ্চিত দরিদ্ররা

ইমরান হাসান রাব্বী ইমরান হাসান রাব্বী , শেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৬:০২ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০২৩

শেরপুরে নানা সংকটে ধুঁকছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। অধিকাংশ ক্লিনিকের ভবনগুলোর জরাজীর্ণ ও বেহাল দশা, চাহিদার তুলনায় ওষুধের সরবরাহ কম এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) অনিয়মিত যাতায়াতের কারণে দেখা দিয়েছে এ সংকট। এতে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জেলার প্রান্তিক অঞ্চলের হতদরিদ্র জনসাধারণ।

তবে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, বেহাল ভবনগুলো মেরামতে তালিকা প্রস্তুত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হচ্ছে। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জোরদার করা হচ্ছে মনিটরিং।

জানা গেছে, দেশের প্রান্তিক মানুষের দোঁরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ১৯৯৯ সালে সরকার সারাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করে। এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া কথা। তবে অযত্ন-অবহেলা, অনিয়ম আর জরাজীর্ণ ভবনের কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শেরপুরে ১৬৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে ৫৩টি, শ্রীবরদীর ১০ ইউনিয়নে ৩৫টি, নালিতাবাড়ীর ১২ ইউনিয়নে ৩৪টি, নকলার ৯ ইউনিয়নে ২৪টি এবং ঝিনাইগাতীর সাত ইউনিয়নে ২৩টি ক্লিনিক রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই জরাজীর্ণ ও বেহাল দশা। কোনোটির ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। বর্ষাকালে ওইসব ক্লিনিকে বসে সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার কোনোটির পলেস্তারা খসে পড়েছে। অনেকে ভয়ে ক্লিনিকে সেবা নিতেই যান না।

জেলার ১৬৯টি ক্লিনিকের মধ্যে কেবল চারটি ব্যতীত বাকি সবগুলোতেই সিএইচসিপি রয়েছেন। প্রতিটি ক্লিনিক সপ্তাহে ছয়দিন খোলা থাকার কথা এবং সিএইচসিপির পাশাপাশি তিনদিন করে একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন পরিবার পরিবার পরিকল্পনা সহায়কের সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা। তবে বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।

সরেজমিনে রোববার (১৫ জানুয়ারি) সকালে সদর উপজেলার যোগিনীমুরা কমিউনিটি ক্লিনিক ও শ্রীবরদী উপজেলার খরিয়াকাজীরচর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, সেগুলো তালাবদ্ধ। যোগিনীমুরা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি আমিনুল ইসলামের মোবাইলফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। আর খরিয়াকাজীরচর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি আবুল কালাম মোবাইলফোনে জানান, তিনি করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচির প্রস্তুতির জন্য পাশের এলাকায় গিয়েছিলেন।

তবে স্থানীয়রা জানান, এসব ক্লিনিকের সিএইচসিপিরা সপ্তাহে তিন/চারদিনের বেশি আসেন না। সকাল ১০টা-১১টায় এলেও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ক্লিনিক বন্ধ করে চলে যান।

এদিকে, সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মির্জাপুর ও পশ্চিম কুমরী কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, সেবাপ্রত্যাশী নারীদের ভিড়। সেখানে সিএইচসিপির কাছে সমস্যার কথা বলে ওষুধপত্র নিচ্ছেন তারা। তবে সংকটের কারণে মাসের শেষের দিকে ওষুধ পাওয়া যায় না বলেও অভিযোগ তাদের।

পশ্চিম কুমরী এলাকার মালেছা বেগম বলেন, আমরা সাধারণ অসুখ-বিসুখে এ ক্লিনিক থেকে ওষুধ নেন। তবে মাসের শেষে ওষুধ পাওয়া যায় না। সরকার ওষুধের বরাদ্দ বাড়ালে আমাদের জন্য ভালো হতো।

শ্রীবরদীর খরিয়াকাজীরচর এলাকার আলেছা বেগম বলেন, ‘এই ক্লিনিকটা ভাইঙাচুইরা গেছে। বৃষ্টির দিন ভিতরে পানি পড়ে। তখন আমার বাড়িতে বসে ওষুধ দেয়। বিল্ডিংটা ঠিক করা দরকার। নাইলে কোনদিন জানি ভাইঙা পড়ে যাব।’

স্থানীয় বাসিন্দা মো. আব্দুর রহিম বলেন, সিএইচসিপি প্রতিদিন ঠিকমতো আসেন না। মাঝে মাঝে আসেন। আসলেও দুপুরের আগেই ক্লিনিক বন্ধ করে চলে যান।

সদর উপজেলার যোগিনীমুরা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল জব্বার জানান, সিএইচসিপি আমিনুল ইসলাম ১০টার দিকে আসেন, আবার দুপুরের আগেই চলে যান। সপ্তাহে তিন/চারদিনের বেশি আসেন না। এতে এলাকার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আরেক বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম দাবি করেন, এখানের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি ভবনটিরও দেখভাল করেন না। এতে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভবনটি নষ্ট হচ্ছে।

মির্জাপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি নুসরাত জাহান বলেন, ক্লিনিকে ২৭ প্রকারের ওষুধ দেওয়া হয়। দুই মাসের জন্য সেগুলো দেওয়া হলেও তা ছয় হাজার মানুষের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এজন্য মাসের শুরুতেই তা শেষ হয়ে যায়। বিশেষ করে বাচ্চাদের সর্দি-জ্বর ও পাতলা পায়খানার সিরাপের চাহিদা বেশি থাকলেও তা কম পাওয়া যায়। বরাদ্দ আর একটু বাড়ালে আমাদের জন্য ভালো হতো।

ঝিনাইগাতী উপজেলার দিঘীরপাড় ও রাঙামাটিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকসহ কয়েকটি ক্লিনিকে যাতায়াতের রাস্তা কাঁচা হওয়ায় বর্ষাকালে সেবা নিতে ভোগান্তিতে পড়েন রোগীরা। তাই ক্লিনিকে যাতায়াতের রাস্তা দ্রুত পাকা করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

নালিতাবাড়ী উপজেলাতেও অধিকাংশ ক্লিনিকের ভবন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কোথাও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। তবে কোনো কমিউনিটি ক্লিনিকেই রোগীদের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই।

রূপনারায়ণকুড়া ইউনিয়নে সড়কের পাশে কিল্লাপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, ক্লিনিকটি সড়ক থেকে অনেক নিচুতে। যেখানে একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয় বাসিন্দা নিয়ামুল মান্না বলেন, ‘ক্লিনিকে তো সময়মতো লোক পাওয়া যায় না। ওষুধ আনবার গেলে শুনি ওষুধ শেষ হইয়া গেছে। পরে বাধ্য হইয়াই উপজেলা হাসপাতালে যাই।’

কিল্লাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মমতাজ বেগম বলেন, ‘দুপুর না হইতেই তো ক্লিনিক বন্ধ হইয়া যায়।’

এ বিষয়ে শেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. অনুপম ভট্টাচার্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোঁড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মান আরও বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। এতে সেবার মান আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে, আশা করছি সেবার মান আরও বাড়বে।

তিনি আরও বলেন, জেলার জরাজীর্ণ ভবনগুলো মেরামতযোগ্য, ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ- এ তিন ক্যাটাগরিতে তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, এ বিষয়েও শিগগির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর বর্তমানে ওষুধের কোনো সংকট নেই। তবে সরকার যদি বরাদ্দের পরিমাণ আরও বাড়ায়, তাহলে জনগণকে আরও বেশি পরিমাণে ওষুধ দেওয়া সম্ভব হবে।

এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।