বিদায়ী বছরে পানিতে ডুবে ১৬৭১ শিশুর মৃত্যু
২০২২ সালে বাংলাদেশে পানিতে ডুবে এক হাজার ৬৭১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন’। গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫১টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর জরিপ করে তারা এই সংখ্যা পেয়েছে।
মৃত্যুর কারণ হিসেবে মৃগী রোগী, আঘাতজনিত মৃত্যু বা দুর্ঘটনা, সাঁতার না জানা, অসচেতনতা এই চারটি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মৃতদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৩৬ শতাংশ ছেলে এবং ৩৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ মেয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করেছে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু ৯৬০ জন যা মোট মৃতের ৫৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
সোমবার (১৬ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টায় টাঙ্গাইল শহরের শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
আরও পড়ুন: পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু যেন ‘নীরব মহামারি’
সংবাদ সম্মেলনে শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশনের পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধ প্রকল্পের সমন্বয়কারী মুবাশ্বির খান লিখিত বক্তব্যে জানান, সবচেয়ে বেশি শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম জেলায় (১৩২ জন), দ্বিতীয়তে রয়েছে নেত্রকোনা (৬৭ জন)। এরপর যথাক্রমে কক্সবাজার (৬৫ জন), চাঁদপুর (৫৫ জন), সুনামগঞ্জ (৫৪ জন)।
এছাড়া সবচেয়ে বেশি শিশু মারা গেছে সেপ্টেম্বর মাসে ২২৮ জন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে জুলাই মাসে ২০০ জন এবং সবচেয়ে কম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ফেব্রুয়ারি মাসে ৬৫ জন।
এদিকে, মোট ঘটনার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ ঘটানোর জন্য দায়ী অসচেতনতা। এমনও দু-একটি ঘটনা দেখা গেছে যেখানে বালতি কিংবা পাতিলের পানিতে ডুবেও শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। মা-বাবা বা শিশুর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যখন কাজে ব্যস্ত থাকেন বা বিশ্রামরত থাকেন তখনই সিংহ ভাগ শিশুর মৃত্যু ঘটে। বিশেষ করে সকালে কাজের সময় থেকে শুরু করে দুপুরের বিশ্রামের সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
আরও পড়ুন: চুয়াডাঙ্গায় বালতির পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সাঁতার না জানার কারণে পাঁচ বছরের ওপরে ৩১ দশমিক ০৭ শতাংশ শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শীতকালের চেয়ে বর্ষা বা তুলনামূলক গরমের সময় পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। শহরের তুলনায় গ্রামের শিশুদের নদী, পুকুর বা ডোবায় গোসল করতে গিয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করতে দেখা গেছে। শহরে মারা যাওয়া বেশির ভাগ শিশুই পাঁচ বছরের ওপরের এবং সিংহ ভাগ সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মারা যায়।
সংবাদ সম্মেলনে শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মুঈদ হাসান তড়িৎ বলেন, পত্রিকা ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংবাদ বিশ্লেষণ করে আমাদের এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অনেক ঘটনায় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি, যেগুলো হিসাব করলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন মতে, সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু ঘটছে অসচেতনতার কারণে। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধে সংবাদ সম্মেলনে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন আয়োজকরা। প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে, শিশুর যত্নে দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের সব সময় মা-বাবা বা অন্য কারও দায়িত্বে রাখা, পুকুর বা ডোবার চারপাশে বেড়া দেওয়া, দলবেঁধে বা একাকি শিশুকে জলাশয়ে গোসল করতে না দেওয়া, বালতি বা পানি পূর্ণ পাত্র সব সময় ঢেকে রাখা, পাঁচ বছর বয়স হলে শিশুকে সাঁতার শেখানো, সাঁতার শেখার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
আরও পড়ুন: বিয়েবাড়ি বেড়াতে এসে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু
এছাড়া নদীপথে যাত্রার সময় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা অবলম্বন করা, ঝুঁকিপূর্ণ নৌযাত্রা পরিহার করা, অভিভাবকদের সচেতন করা, পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় ও পরে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর করণীয় সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেওয়া, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তা ব্যবহারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, দেশব্যাপী গণসচেতনা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া, শহরের শিশুদের বাধ্যতামূলক সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করা, নিয়মিত তৃণমূল পর্যায়ে সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, যথাযথ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করা, এ সম্পর্কিত কাজে আগ্রহী সমাজকর্মী ও সংগঠনকে যথাযথ সহযোগিতা করা।
সংবাদ সম্মেলনে শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশনের পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধ প্রকল্পের সদস্য মির্জা রিয়ান ও আতিয়া আদিবা জারা উপস্থিত ছিলেন।
আরিফ উর রহমান টগর/এমআরআর/এএসএম