গুদামে চাল দিয়ে লোকসানে চালকল মালিকরা
চলতি আমন মৌসুমে নওগাঁয় সরকারি গুদামে ধান সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ পূরণ হওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। খোলা বাজারে ধানের দাম বেশি পাওয়ায় এবং গুদামে নানা প্রতিবন্ধকতায় ধান দিতে অনীহা দেখান চাষিরা।
তবে অভিযান সফল করতে চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকরা কেজিতে দুই-তিনটাকা লোকসান দিয়ে গুদামে চাল সরবরাহ করছেন। এতে করে এ মৌসুমে চালকল মালিকদের প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা লোকসান হবে। লোকসান পুষিয়ে নিতে সরকারের কাছে প্রণোদনার দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত চালকল মালিকরা।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নওগাঁর ১১টি উপজেলার ১৯টি খাদ্য গুদামে চলতি আমন মৌসুমে ২২ হাজার ১৩৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ হাজার ৪৫৪ মেট্রিক টন। গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। জেলার ৫৬৯টি চালকলের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ৩৮১টি।
আরও পড়ুন: সপ্তাহের ব্যবধানে নওগাঁয় চালের কেজিতে বেড়েছে ৫ টাকা
রোববার (১৫ জানুয়ারি) পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। তবে সংগ্রহের প্রথম দিন মাত্র এক মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ হলেও এখন পর্যন্ত গুদামে আর কোনো ধান দেননি কৃষকরা। ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম চলবে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন পর্যন্ত।
এবার আমন মৌসুমে প্রতি কেজি ধান ২৮ টাকা এবং সিদ্ধ চাল ৪২ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। যা গত মৌসুমের (২০২১-২২ অর্থবছর) তুলনায় কেজিপ্রতি ধান এক টাকা ও চাল দুই টাকা বেশি।
চলতি আমন মৌসুমে ধানের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সরকার নির্ধারিত প্রতি মণ ধানের দাম ১১২০ টাকা (২৮ টাকা কেজি) হলেও খোলা বাজারে দাম এর চেয়েও বেশি। গুদামে ধান দিতে শুকানো, বাতাস করা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা রকম বিড়ম্বনা পোহাতে হয় বলে দাবি চাষিদের। এ বিড়ম্বনা এড়াতে খোলা বাজারে ধান বিক্রি করেন তারা।
এদিকে, এ অবস্থায় অনেকটা অলস সময় পার করছেন গুদামের শ্রমিকরা। আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় কষ্ট করে সংসার চালাতে হচ্ছে তাদের।
নওগাঁ জেলা সরকারি খাদ্য গুদাম শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিঠু মণ্ডল বলেন, জেলা সদরে ৮৯ জনসহ জেলার ১৯টি খাদ্য গুদামে প্রায় ৩০০ জন শ্রমিক আছি। গত দুই-তিন বছর থেকে ধান-চাল সংগ্রহ কম হচ্ছে। আমাদের শ্রমিকরা অধিকাংশ সময় অলস বসে থাকে। কাজ কম হওয়ায় আয়ও কমে গেছে। দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়, যা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: নওগাঁয় ধানের দাম বেড়েছে মণে ৮০ টাকা
রানীনগর উপজেলার কৃষক মিলন হোসেন বলেন, দুই-তিন বছর থেকে সরকারের দামের চেয়ে আমরা খোলা বাজারে বেশি দাম পাচ্ছি। খোলা বাজারে ধান দিলে কোনো ধরনের বিড়ম্বনা পোহাতে হয় না। টাকাও নগদ পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, যখন খোলা বাজারে ধানের দাম কম এবং সরকারের দাম বেশি ছিল তখন গুদামে ধান দিয়েছি। গুদামে ধান দিলে শুকানো, ধুলাবালি পরিষ্কার করাসহ নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। এছাড়া ধান দিয়ে টাকা পেতে দুই-তিনদিন ঘুরতে হয়। একারণে গুদামে ধান দিতে অনীহা। দাম কিছুটা কম পেলেও খোলা বাজারে বিক্রি করি।
জেলার মহাদেবপুর উপজেলার সরস্বতীপুরে প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবার হাট বসে। এ হাটের ধান ব্যবসায়ী জামান হোসেন বলেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের ধানের দাম বেড়েছে মণে ৫০ টাকা। বর্তমানে স্বর্ণা-৫ জাতের ধান ১২০০ টাকা, ৪৯ জাতের ধান ১৩০০ টাকা, চিনিগুড়া ২৪৫০ টাকা, ৯০ জাতের ধান ২২৫০ টাকা এবং ৫১ জাতের ধান ১১৭০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি ধান কেনায় দাম বেড়েছে। তারা হাটে না আসলে দাম কমে যায়। এ হাটে প্রায় চার হাজার মণ ধানের সরবরাহ হয়। প্রায় ৫০-৫৪ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়।
আরও পড়ুন: ‘না পারছি আবাদ বাদ দিতে, না পাচ্ছি ধানের ন্যায্য দাম’
রানীনগর উপজেলা চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোছাদ্দেক খান বলেন, উপজেলার ৪৫টি চালকল চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। লোকসান করে সরকারকে চাল দিচ্ছি। এতে করে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, বাজারে ধানের দাম বাড়তি থাকায় চাল করে গুদামে সরবরাহ করতে প্রতি কেজিতে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা খরচ পড়ছে। কিন্তু সরকার দাম দিচ্ছে ৪২ টাকা। এতে কেজিতে লোকসান হচ্ছে দুই থেকে তিনটাকা। সে হিসাবে এ মৌসুমে চালকল মালিকদের প্রায় চার কোটি ৪২ লাখ ৭২ হাজার টাকা লোকসান হবে।
তিনি বলেন, সরকারকে সহযোগিতা করতে গত তিন বছর থেকে লোকসান করে গুদামে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত চালকল মালিকদের লোকসান পুষিয়ে নিতে সরকারের কাছে প্রণোদনার দাবি জানানো হয়েছে।
চালকল মালিক সমিতির এ নেতা বলেন, খোলা বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় সরকার ধান পাচ্ছে না। সরকারকে সহযোগিতা করতে আমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। তবে আগামী বছরও যদি ধান-চালের দামের সামঞ্জস্য না থাকে সরকারের সংগ্রহ অভিযান সফল হবে না। এমনকী গুদামে চাল সরবরাহ করা হবে না। কারণ আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। লোকসানও ব্যাপক হয়েছে।
নওগাঁ সদর উপজেলার খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, আমাদের উপজেলায় ১৪ মেট্রিক টন ধান এবং ৯ হাজার ৩৭৪ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পেয়েছি। এরইমধ্যে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। আশা করছি, বাকিটাও সংগ্রহ হবে। তবে উদ্বোধনের দিনে এক মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ হয়েছে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে খোলা বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় কৃষকরা গুদামে ধান দিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: চালের দামে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কতটা যৌক্তিক?
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আলমগীর কবীর বলেন, রোববার পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকরা গুদামে চাল সরবরাহ করেছেন এবং লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ অর্জিত হবে বলে আশাবাদী। তবে খোলা বাজারে ধানের দাম বেশি পাওয়ায় কৃষকরা গুদামে সরবরাহ করছেন না।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আমন মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এছাড়া এ মৌসুমে জেলায় ৯ লাখ ৩২ হাজার ২১৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে।
আব্বাস আলী/এমআরআর/জেআইএম