ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষে ভাগ্য বদল কৃষকের
মাদারীপুরের কালকিনিতে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করেছেন অর্ধশতাধিক কৃষক। উপজেলার রমজানপুর ইউনিয়নের পানিতে ডুবে থাকা পরিত্যক্ত জমিতে সবজি চাষ করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তারা। তাদের দেখে জেলার অনেকে এ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, রমজানপুর ইউনিয়নের নিচু জমিসহ পতিত জলাশয়গুলোতে পানি ডুবে থাকে। ফলে ওই সব জমিগুলোতে তেমন চাষাবাদের সুযোগ না থাকায় বছরের প্রায় সময়জুড়ে পরিত্যক্ত পড়ে থকে। সেই জমিগুলো এখন সবজিতে ভরে গেছে। বর্তমানে বছর জুড়ে নানা সবজিতে ভরে থাকে এসব জমি ও জলাশয়। ইউনিয়নের প্রায় ৫০ জন কৃষক তাদের নিজ জমিসহ সুবিধামতো জমিগুলোতে গড়ে তুলেছেন ভাসমান সবজির বাগান। এতে করে এ ইউনিয়নের কৃষকরা নিজেদের ভাগ্য বদল করেছেন। ফসলি জমি ও পতিত জলাশয়গুলোতে কৃষকরা কচুরিপানা দিয়ে বেড তৈরি করে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ছাড়াই সবজি চাষ করে তা বাজারে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। এ কৃষকরা অল্প খরচে চাষ করে বেশি লাভে বিক্রি করতে পারায় খুব খুশি। এদিকে কীটনাশক ছাড়াই সবজি চাষ করায় এর চাহিদাও বেশি।
কালকিনি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, উপজেলায় ৫০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে কালকিনির রমজানপুর ইউনিয়নে ২০ বিঘা জমিতে ৫০ জন কৃষক ভাসমান বেডে বিষমুক্ত সবজি চাষ করেছেন। খুব সহজেই অল্প খরচে কচুরিপানা দিয়ে এ ভাসমান বেড তৈরি করা হয়। বেড তৈরি করে সরকারি কৃষি অধিদপ্তরের পরামর্শ নিয়ে বিঘা প্রতি ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচে তৈরি করা সম্ভব এ ভাসমান সবজি বাগান। একবার বেড তৈরি করলেই সারা বছর সেখানে খুব সহজেই সবজি চাষ করা সম্ভব। লাউ, শসা, করলা, মিষ্টি কুমড়ো এ চার ধরনের সবজি খুব সহজেই এ বেডে চাষ করা যায়। এছাড়াও লাল শাক, ডাটা, ঢেঁড়সসহ অন্যান্য সবজিও চাষ করা যায়। তেমন কোনো সারের প্রয়োজন হয় না। ফলে বিষমুক্ত সবজি জন্মায় এ ভাসমান বেডে।
উত্তর রমজানপুরের কৃষক আশরাফুর রহমান বলেন, প্রথমে এখানে শাহিন রাঢ়ি নামের এক কৃষক এ ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু করেন। তার কাছ থেকে শিখে আমরাও চাষ শুরু করেছি। এ পদ্ধতিতে খুব অল্প খরচে বিষমুক্ত সবজি চাষ করা যায়। লাভও বেশি হয়। এখন এ ইউনিয়নের অনেক কৃষক ভাসমান বেডে সবজি চাষ করছেন।
এ বিষয়ে কৃষক শাহিন রাঢ়ি বলেন, উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় আমি ভাসমান পদ্ধতিতে সর্বপ্রথম সবজি চাষ শুরু করে লাভবান হয়েছি। আমার দেখা দেখি অনেকেই এখন এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। এতে করে এ ইউনিয়নে পড়ে থাকা জমি ও জলাশয়গুলো এখন সবজিতে ভরে গেছে।
তিনি বলেন, কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান বেড তৈরি করা হয়। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কচুরিপানা সংগ্রহ করে স্তূপ করা হয়। পরে বিভিন্ন লতা জাতীয় জলজ গাছ সংগ্রহ করে আস্তে আস্তে স্তর সাজিয়ে এ বেডগুলো তৈরি করা হয়। বেডগুলো ২-৩ ফুট পুরু করে ১০-১২ দিনের মধ্যেই ভাসমান ধাপ বা বেড তৈরি হয়ে যায়। এছাড়াও অনেকে এ বেড তৈরি করতে বাঁশ, নারিকেলের খোসার গুড়া, তুষও ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া এগুলো তৈরি করতে একটি নৌকা বা কলাগাছ দিয়ে তৈরি ভেলা কিংবা তালের ডোঙ্গার (নৌকা) প্রয়োজন হয়। সব কিছু হয়ে গেলে বীজতলা তৈরি করে যে যার পছন্দমতো ভাসমান বাগান তৈরি করেন।
দক্ষিণ রমজানপুরের কৃষক জুলহাস মোল্লা বলেন, বাড়ির পাশে প্রায় ৪০ শতাংশ জলাবদ্ধ জমিতে কচুরিপানা দিয়ে প্রথমে ভাসমান বেড তৈরি করি। পরে শীতের সবজি চাষ করেছি। এখন সেই লাউ বাজারেও বিক্রিও করছি।
একই এলাকার কৃষক মো. জলিল বলেন, আমার কিছু জমি বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা থাকতো। সেই জমিগুলোতে এখন ভাসমান বেড তৈরি করে শসা, লাল শাক, ঢেঁড়স ও লাউ চাষ করছি। আল্লাহর রহমতে ফলন ভালো হয়েছে। বাজারেও এ সারমুক্ত সবজির চাহিদা বেশি থাকায় অল্প খরচে বেশি লাভ করতে পেরেছি।
কালকিনি উপজেলা কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ বলেন, রমজানপুর ইউনিয়ন নিচু হওয়ায় অনেক জমিতেই বছর জুড়ে পানি থাকে। তাই সেইসব জমিতে ইউনিয়নের প্রায় ৫০ কৃষক ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে নিজেদের ভাগ্য বদলেছেন। এ সব কৃষকদের উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি প্রযুক্তিগত সহায়তা করা হয়েছে। তাছাড়া আমি তাদের সব সময় নানা ধরনের পরামর্শ দিয়েছি। এতে করে ওই এলাকার অনেক কৃষক সবজি চাষ করে আয় করছেন।
মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ভাসমান পদ্ধতিতে অধিক ফলন ও সবজির বাজারদর ভালো থাকায় অল্প খরচে কৃষকরা লাভবান হতে পারছেন। তাই এ পদ্ধতি জেলাজুড়ে দিনে দিনে জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন এবং লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছেন।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/আরএইচ/জেআইএম