সংস্কার হচ্ছে শত বছরের হরিপুর জমিদার বাড়ি
সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর জমিদার বাড়িটি। দেওয়ালে শেওলা, মানুষের মল ও পঁচা দুর্গন্ধে ভরপুর জমিদারের বাড়ি। অতি বৃষ্টির কারণে ধসে পড়েছে সিঁড়ির ছাদ। তবে শতাব্দীরও পুরনো বাড়িটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসক।
এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সংস্কারের কাজ। দেয়ালের শেওলা আর জঙ্গল উপড়ে দেওয়া হয়েছে রঙের প্রলেপ। লতাপাতায় আচ্ছন্ন ভূতরে বাড়ি নয়, এখন দূর থেকে দেখলেই মনে হয় এটি জমিদারের বাড়ি।
জমিদার বাড়ির দেয়ালে ঝোলানো সাইনবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় প্রথম ধাপে হরিপুর জমিদার বাড়ি সংস্কারের কাজ চলছে।
২০ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত যা কাজ হয়েছে তা দেখতেই দুর দুরান্ত থেকে ছুটির দিনে আসছে দর্শনার্থীরা। তারা ছবি তোলার পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়ে বাড়িটিকে পর্যটন কেন্দ্রের পরিবেশ সৃষ্টি করার কথা বলছেন।
কালের সাক্ষী হয়ে থাকা এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই তরুণ প্রজন্মের। সংস্কার কাজ শেষ হলে আর দুর্গন্ধ নয়, দেশের সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে দেশের সব প্রান্ত থেকে পর্যটক আসবে প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।
শনিবার ছুটির দিনে ঠাকুরগাঁও সদর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে এই জমিদার বাড়িটি দেখতে আসা এমদাদ উল হক বলেন, এর আগে জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছিলাম। তখন দুর্গন্ধে ভেতরে যেতে পারিনি। এখন বাড়িটি দূর থেকে দেখলে জমিদারের বাড়ি মনে হয়। এখনো কাজ চলছে আশা করি একদিন ইতিহাস ঐতিহ্যকে জানতে সারাদেশ থেকে মানুষ জমিদার বাড়িতে আসবে।
স্থানীয় দোকানদার জাকির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আগে দুর্গন্ধে ভরপুর ছিল জমিদার বাড়িটি। কেউ আসতো না এখানে। এখন কাজ চলছে তাতেই লোকজন আসছে। এখন দুর্গন্ধ নেই। জমিদার বাড়িতে যেন সব সময় দর্শনার্থী আসে এমন উদ্যোগ নিলে আমাদের বিক্রি বাড়বে।
স্থানীয়রা জানান, পুরনো এ ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ময়লাস্তুপে থাকা জমিদার বাড়িটি করোনা মহামারির সময় নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করে স্থানীয় শিশু, কিশোর ও যুবকরা। এটি সংস্কারের দাবিতে সড়কে দাড়িয়ে মানববন্ধনসহ শিক্ষা জীবনে বাড়িটির গুরুত্ব তুলে ধরে লিফলেটও বিতরণ করেছিল তারা।
কিন্তু এ আয়োজন বেশিদিন টিকেনি। আবারও মলত্যাগ আর মাদকসেবীদের আড্ডায় পরিণত হয় জমিদার বাড়ি।
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহাবুবুর রহমান বাড়িটিতে পরিদর্শনে এসে প্রথম সংস্কারের উদ্যোগ নেন।
জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ির পেছনের দেওয়ালে হালকা নকশা। দেওয়ালের উপরে জমিদার যোগেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর খোচিত মূর্তি। দোতালা বাড়ির সামনের অংশে দুটি সিঁড়ি একটি ভাঙ্গা। বাড়ির ভেতরে বেশ কিছু কক্ষ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে জমিদারি পরিচালনার জন্য কাচারি, ধর্মীয় উৎসবের জন্য বিভিন্ন উপাসনালয়, বিনোদনের জন্য নাচমহল, নাগমহল, অন্দরমহল ও অন্ধকূপ ইত্যাদি।
হরিপুর জমিদার বাড়ির শাসনামল, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, সংগ্রাম, প্রতিবাদ, বর্বরতা, সে সময়ের এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, নৈতিকতা স্থানীয় প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এটির সংস্কার দাবি ছিল স্থানীয় যুবসমাজ ও শিক্ষার্থীদের। কারণ হরিপুরের সমাজ প্রবর্তন ইতিহাসের একমাত্র কালের সাক্ষী এই জমিদার বাড়িটি।
স্থানীয় উদ্যোগে গড়ে তোলা হরিপুর জমিদার বাড়ি সংস্কার ও সংরক্ষণ কমিটি আহ্বায়ক সালমান ফার্সি জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে সংস্কারের পর রাজবাড়ীর রূপ সবাইকে মুগ্ধ করেছে। আমার বিশ্বাস কান্তজীউ মন্দিরের পর উত্তরবঙ্গের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে এটাকে গড়ে তোলা সম্ভব। এ বিষয়ে আমরা সবার কাছেই সহযোগিতার আবেদন করেছি। যদি জমিদার বাড়িটি সংস্কারের পর এর ইতিহাস নিয়ে কাজ করা যায় তথা দর্শনার্থীর জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করে ইতিহাস জানানোর সুযোগ করে দেওয়া যায় তাহলে দেশের সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে এখানে সব প্রান্তের শিক্ষার্থীদের আসার আগ্রহ হবে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহাবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, হরিপুর জমিদার বাড়িটি অনেক পুরাতন। সংস্কারে উপযোগী থাকায় কাজ করানো হচ্ছে। পাশের উপজেলাতে আরেকটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রয়েছে সেটির দেয়াল মজবুত আছে কিনা যাচাই করতে হবে। সেই বাড়ির ভেতরে আমার প্রবেশ করা হয়নি। সংস্কার উপযোগী হলে এসব প্রাচীন স্থাপনা সংস্কার করা হবে।
হরিপুর উপজেলার মোসলিম উদ্দীন কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করিমুল হকের লেখা ‘হামার বাড়ি হরিপুর’ নামক একটি সংখ্যায় হরিপুর জমিদার বাড়ির বিষয়ে গবেষকদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে, ঘনশ্যাম কুণ্ডু নামক একজন বর্ণাঢ্য কাপড় ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে হরিপুরে আসেন। সেই সময় মেহেরুন্নেসা নামে এক বিধবা মুসলিম মহিলা এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। খাজনা অনাদায়ের পড়ার কারণে মেহেরুন্নেসার জমিদারির কিছু অংশ নিলাম হয়ে গেলে ঘনশ্যাম কুণ্ডু কিনে নেন।
ঘনশ্যামের ছেলে রাঘবেন্দ্র রায় চৌধুরী ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে হরিপুর জমিদার বাড়ির প্রথম স্থাপনা ফলক নির্মাণ করেন। কিন্তু তার সময়ে রাজবাড়ির সমস্ত কাজ শেষ হয়নি। রাঘবেন্দ্র রায়ের পুত্র যোগেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে রাজবাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ করেন।
যোগেন্দ্রনাথের ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথ বিহারী রায় চৌধুরী জমিদার বাড়ির উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্ত বড় তরফ ও ছোট তরফে ভাগাভাগি করে নেন। পরবর্তীতে বড় তরফ থেকে জমিদার যোগেন্দ্র নারায়ণের দুই ছেলে জমিদারি চালান। তারা হলেন রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ও বিশ্বেন্দ নারায়ণ রায় চৌধুরী। আরেক ভাই নগেন্দ্র নারায়ণের দুই ছেলে রমেন্দ্র কৃষ্ণ রায় চৌধুরী ও গিরিজা বল্লভ রায় চৌধুরী জমিদার বাড়িতে বসবাস করতেন তার মধ্যে রমেন্দ্র ঘরকুনো স্বভাবের হলেও গিরিজা বল্লভ রায় ছিলেন আমুদ প্রকৃতির। নাচ, গান ও ক্রীড়ানুরাগী। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় তারা ভারতে চলে যান। দীর্ঘদিন এ বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে জমিদার বাড়িটি সংস্কার করে বাংলাদেশ সরকার।
তানভীর হাসান তানু/জেএস/জেআইএম