বোতল ও সফটওয়্যারে গাছের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করেন আমিনুল

রাশেদুল ইসলাম রাজু রাশেদুল ইসলাম রাজু , সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৫:২১ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২

অডিও শুনুন

বোতলের মাধ্যমে গাছে পরিমিত পুষ্টি উপাদান সরবরাহ এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে গাছের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আমিনুল ইসলাম। নিজ বাড়ির খালি জায়গায় এবং ছাদের বিভিন্ন গাছে তার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি ব্যবহার করে লেবু, কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন ফসলে সফল হয়েছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের পূর্ব সাহেবপাড়া এলাকার আল হেরা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল সংলগ্ন তার বাড়িতে গিয়ে এমনই চিত্র চোখে পড়ে।

সরেজমিনে দেখা যায়, তার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি ব্যবহার করায় একটি গাছে সাধারণত যে পরিমাণ ফল পাওয়া যায় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ফল পাচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন গাছপালা নিয়ে প্রায় ১০ বছর গবেষণার পর তিনি এই দুটি পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। দীর্ঘ এই সময় গবেষণা করতে গিয়ে আমিনুলের ১ লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে।

আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, স্কুলজীবন থেকেই তার গবেষণার প্রতি অন্যরকম আগ্রহ ছিল। পাশাপাশি ছোটবেলা থেকে তিনি প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতেন কিন্তু কিছু গাছে ফল হতো আবার কিছু গাছে ফল হতো না। তখন তিনি এর কারণ বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন। হঠাৎ একদিন খেয়াল করলেন টয়লেটের আশপাশের গাছগুলো তুলনামূলক বেশি মোটা ও বড় হয়ে থাকে। তখন এর কারণ বের করতে গিয়ে তিনি দুটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

আমিনুলের জন্ম কুমিল্লার মুরাদনগরে হলেও তার বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ২০০৪ সালে বর্ণমালা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি দেন। ২০০৮ সালে ইসলামিয়া ব্যাংক ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন।

উদ্ভাবনের বিষয়ে আমিনুল বলেন, বোতলের মাধ্যমে গাছে পরিমিত পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে তিনি প্রতিটি গাছে দুটি করে বোতল লাগিয়েছেন। গাছে একটি বোতলের মাধ্যমে এনার্জি এবং আরেকটি বোতলের মাধ্যমে ফুল-ফলের উপাদান দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যদি গাছে ফুল-ফল চান তাহলে ওই বোতলে পরিমিত মাত্রায় পানি দিতে হবে আবার যদি গাছের এনার্জী চান তাহলে এনার্জির বোতলে পরিমিত মাত্রায় পানি দেবেন।

তিনি গাছের এনার্জীর জন্য তৈরিকৃত বোতলে মুরগির বিষ্টা, নাড়িভুড়ি, শাকসবজির ফেলে দেওয়া অবশিষ্ট অংশ ব্যবহার করেছেন। তবে যে কেউ চাইলে শুধু মুরগির নাড়িভুড়ি বেশি করে ব্যবহার করে গাছের এনার্জী বোতল বানাতে পারবেন।

অপরদিকে গাছের ফুল-ফলের জন্য তৈরিকৃত বোতলে তিনি শুধু কলার খোসা ব্যবহার করেছেন। দুটি বোতলের সরু প্রান্তটি গাছের মাটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে এবং অপর প্রান্তটির মুখ খোলা রাখা হয়েছে পানি দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ বোতলের উপরের প্রান্তে পানি দেওয়া হলে তা বোতলের মধ্যে থাকা উপাদানগুলোর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে মাটিতে যায়। এর ফলে মাটি পুষ্টি উপাদান সঠিকমতো পাবে।

বিনা খরচেই যে কেউ এটি তৈরি করতে পারবে। ১০-১৫ বছরেও এইসব প্লাস্টিকের বোতল নষ্ট হয় না তাই এই পদ্ধতিটি দীর্ঘদিন গাছে ব্যবহার করা যায়।

আমিনুলের দ্বিতীয় প্রযুক্তিটি হলো সফটওয়্যারের মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রণ করা। এর ফলে যেকোনো স্থান থেকে গাছের খাবার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই প্রযুক্তিটি তৈরি করতে তিনি প্রথমে তিনটি অংশ তৈরি করেছেন।

রিসিভার অংশ, মেকানিক্যাল অংশ ও ইলেকট্রনিক্স অংশ। যেকোনো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের মাধ্যমে গাছে লাগানো বোতল দুটোতে পরিমিত মাত্রায় পানি দেওয়া সম্ভব হবে। তবে এটি প্রথম পদ্ধতির চেয়ে তুলনামূলক কিছুটা ব্যয়বহুল।

আমিনুল ইসলাম বলেন, গাছ অতিরিক্ত খাবার পেলে মরে যায়। অনেকে টাকা খরচ করে ছাদবাগান করলেও সঠিক খাদ্যের অভাবে আশানুরূপ ফল পান না। তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানোর উৎসাহ পাবেন বলে তিনি মনে করেন।

তিনি জানান, বর্তমানে তার অনুবীক্ষণ যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া তার ল্যাপটপও ঠিকমতো কাজ করে না। সরকার থেকে অনুদান পেলে তিনি নতুন অনুবীক্ষণ যন্ত্র এবং ল্যাপটপ কিনবেন। এতে তিনি তার গবেষণা আরো বড় পরিসরে করতে পারবেন বলে জানান।



আমিনুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মো. জাকারিয়া জানান, আমিনুল ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতো। অনেক মেধা খাটিয়ে আমার ছেলে এই প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করেছে। সারাদিন যখন আমিনুলকে গবেষণা করতে দেখতাম আমি প্রথম প্রথম তাকে বাধা দিয়েছিলাম। কারণ এগুলো করে কোনো কাজ হবে না। শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে। কিন্তু তার অনড় মনোভাব দেখে পরবর্তীতে আর বাধা না দিয়ে তাকে এইসব কাজে আরো উৎসাহ দেই।

আমিনুলের প্রতিবেশী মো. আব্দুল ওয়াদুদ জানান, আমিনুল ইসলাম একজন তরুণ গবেষক। তার উদ্ভাবন নিয়ে আমরা অনেক আশাবাদী। এইসব উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবে। এই এলাকার মানুষ তাকে তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবেই চিনে থাকে।

নারায়ণগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আব্দুল মাজেদ জানান, আমিনুল ইসলাম গাছের খাদ্য নিয়ন্ত্রণে আসলেই এক সুন্দর অভিনব কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। যার মাধ্যমে খাদ্য দ্রুত গ্রহণ করে একটি গাছ থেকে দ্রুত ফল আসে এবং ফলটা পুষ্ট ও রসালো হয়। তিনি প্রায় ১০ বছর এই বিষয়টির ওপর গবেষণা করেছেন। আমরা সেজন্য তার প্রশংসা করেছি। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন যে গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে আমিনুলের এই গবেষণার বিষয়টি আমরা অবহিত করেছি। যেন তারা এই প্রযুক্তিটা গ্রহণ করার মাধ্যমে গবেষণা করে দেশে আরো সম্প্রসারিত করতে পারে। তাছাড়া সরকার থেকে আমাদের কোনো প্রণোদনা দেওয়া হলে একটি অংশ আমিনুলকে দেওয়া হবে।

এফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।