ভাঙা থেকে রক্ষা পেল মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন ‘দেওয়ানের পুল’ সেতু
সচেতন মহলের প্রতিবাদের মুখে সিলেটের গোলাপগঞ্জে মোগল আমলে নির্মিত ‘দেওয়ানের পুল’ নামের ঐতিহাসিক সেতু ভাঙার কাজ বন্ধ করা হয়েছে। সেতু পুনর্নির্মাণ ও প্রশস্ত করার নামে প্রায় ২০০ বছর আগের নির্মিত পুরোনো এই সেতুটি ভাঙার প্রতিবাদ জানান ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট সিলেটের নেতাকর্মীসহ স্থানীয়রা। এর পরপরই এটি ভাঙা বন্ধের নির্দেশ দেয় স্থানীয় প্রশাসন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
ইতিহাস-ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও স্থানীয়রা বলছেন, চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত এ ধরনের দৃষ্টিনন্দন সেতু সিলেটে বিরল। সেতুটিকে ‘প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ’ ঘোষণা করে এর সংরক্ষণ করা জরুরি। একই সঙ্গে ঐতিহ্যের স্বার্থে সেতুটি অক্ষত রেখে বিকল্প সেতু নির্মাণের দাবি তাদের।
ব্ষিয়টি নিশ্চিত করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (চট্টগ্রাম-সিলেট) সাইফুর রহমান বলেন, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নে অবস্থিত প্রাচীনতম মোগল স্থাপত্যের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘দেওয়ানের পুল’ ভাঙা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা এর প্রতিবাদ করায় আজ দুপুর থেকে সেতুটি ভাঙা বন্ধ রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাচীনতম এই সেতু ভেঙে ফেলা হচ্ছে শোনার পরপরই আজ সকালে এটি না ভেঙে সংরক্ষণ করার জন্য গোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রত্নতত্ত্ব আইনের কয়েকটি ধারা উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছি। এর অনুলিপি জেলা প্রশাসককেও দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সেতুটি না ভাঙার জন্য ঘটনাস্থলে আমাদের অফিসার পাঠিয়ে সংশ্লিষ্টদের নিষেধ করা হয়েছে। ঐতিহ্যের এই স্মারক সেতুটি রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সবধরনের ব্যবস্থা নেবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে সেতু ভাঙার আগে নতুন সেতু তৈরির ব্যাপারে যদি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হতো তাহলে আমার বিশ্বাস সেতুটি ভাঙা হতো না। এটি আমাদের একটি বিশাল সম্পদ। সেতুটির পাশে নতুন আরেকটি সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে। তবে এটি ভেঙে নয়। যতটুকু ভাঙা হয়েছে সেটুকু সংস্কার করে সেতুটির সংরক্ষণ করতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর উদ্যোগ নেবে।’
বিগত কয়েক শতাব্দী থেকে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে ছিল দেওয়ানের পুল। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে জানা যায়, উপজেলার বারকোট গ্রামের শেষ সীমানায় প্রায় প্রায় ২০০ বছর আগে পুলটি নির্মিত হয়েছিল।
রেকর্ড অনুযায়ী জানা যায়, মোগল শাসনামলে সম্রাট মুহম্মদ শাহর রাজত্বকালে অল্পকালের জন্য সিলেটের দেওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা) নিযুক্ত হয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে সিলেট আসেন দেওয়ান গোলাব রাম (মতান্তরে গোলাব রায়)। এসময় সিলেট অঞ্চলের ফৌজদার ছিলেন সমসের খান এবং সারা বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন সুজা উদ্দিন খান। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এই ধর্মপ্রাণ দেওয়ান গোলাপগঞ্জের ঢাকা-দক্ষিণে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্যের পিতৃভূমি সম্পর্কে অবগত হন। দেওয়ানের নির্দেশে তৎসময়ে সিলেট থেকে ঢাকা-দক্ষিণ পর্যন্ত সড়ক ও সেতু নির্মিত হয়। এ সড়ক পথে ঢাকা-দক্ষিণ এসে দেওয়ান শ্রী চৈতন্যের পিতৃভূমিতে এক মন্দির স্থাপন করেন। এর সামনে এক দিঘি খনন করান।
হেতিমগঞ্জ থেকে ঢাকা-দক্ষিণগামী সড়কটি আজও ‘দেওয়ানের সড়ক’ নামে পরিচিত। এ সড়কে দেওয়ানের পুলটি গোলাপগঞ্জবাসীর কাছে মোগল স্থাপত্য রীতির একটি নিদর্শন ছিল। যা প্রাচীন দলিল ও রেকর্ডপত্রে তারই সাক্ষ্য বহন করে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ২০০ বছরের এই ঐতিহ্যবাহী সেতুটি অক্ষত রেখে পাশে নতুন আরেকটি সেতু নির্মাণ করা যেতো। সেখানে আরেকটি সেতুর জন্য পর্যাপ্ত জায়গাও আছে। সেতুটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা উচিত।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংগ্রাহক ভাষাসৈনিক মতিন উদদীন আহমদ জাদুঘরের পরিচালক ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার জাগো নিউজকে বলেন, উন্নয়নের নামে মোগল স্থাপত্যের একটি প্রাচীনতম ও দৃষ্টিনন্দন সেতু ভাঙার খবরে আজ আমরা ঘটনাস্থলে যাই। তখনো সেতুটি ভাঙা হচ্ছিল। পরে আমাদের প্রতিবাদের মুখে সেতুটি ভাঙা বন্ধ করেছে এলজিডি।
তিনি বলেন, এ ধরনের একটি অমূল্য সম্পদ কাউকে না বলেই ভেঙে ফেলা ফৌজদারি অপরাধের শামিল। ঐতিহ্যের স্মারক সেতুটি রক্ষার দাবি জানাই।
উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দেওয়ানের পুলটি ছিল ২০ ফুট দীর্ঘ ও ১৬ ফুট প্রস্থ। একই জায়গায় এখন ৯৯ ফুট দীর্ঘ ও ৩২ ফুট প্রস্থ সেতু নির্মাণ করা হবে। এজন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আগামী অর্থবছরে সেতুর সংযোগ সড়কটিও প্রশস্ত করা হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান বলেন, দেওয়ানের পুলটি চুন-সুরকি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেতুটির বয়স অনেক হওয়ায় এটি ভারী যানবাহন বহনের ক্ষমতা হারিয়েছে। তাই নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তার দাবি, এটি প্রাচীন কোনো ইমারত নয়, তাই দেখারও কিছু নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌসুমি মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, প্রাচীনতম এই সেতুটি ভাঙার ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) আমাকে কিছুই জানায়নি। স্থানীয়দের ক্ষোভের বিষয়টি জানতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে সেতুটি ভাঙা বন্ধ করিয়েছি। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেতুটি ভাঙা হচ্ছিল শুনেছি। তবে এটি একটি প্রাচীনতম সেতু হওয়ায় কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা খতিয়ে দেখা হবে।
ছামির মাহমুদ/এসআর/জিকেএস