দেশে ফিরে নির্যাতনের কাহিনী শোনালেন পাচার হওয়া জাহাঙ্গীর

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি যশোর
প্রকাশিত: ০৯:১১ এএম, ২২ ডিসেম্বর ২০২২
প্রবাসে নির্যাতনের শিকার জাহাঙ্গীর হোসেন

ছয় বছর ধরে নিখোঁজ থাকা যশোরের বাঘারপাড়ার সেই জাহাঙ্গীর হোসেন অবশেষে বাড়ি ফিরেছেন। দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে পাচারের শিকার জাহাঙ্গীর ভারত ও লিবিয়ায় নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেলে যশোরের বাঘারপাড়া প্রেস ক্লাবে হাজির হন জাহাঙ্গীর। এসময় গত পাঁচবছরে ঘটে যাওয়া নির্মম নির্যাতনের কাহিনী শোনালেন তিনি।

এদিকে, জাহাঙ্গীরকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা তার পরিবার। তবে দেশে ফিরে অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি। মায়ের দিনমজুরির টাকায় চলছে চিকিৎসা। উন্নত জীবন ও ভালো উপার্জনের স্বপ্ন দেখিয়ে তাকে পাচার করে দেন একই গ্রামের মানিক মিয়া।

জাহাঙ্গীর যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা ইউনিয়নের দোহাকুলা গ্রামের মৃত মাজেদ বিশ্বাসের ছেলে। তিনি পেশায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী ছিলেন। উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ভাঙাড়ি সংগ্রহ করে যশোর ও বাঘারপাড়ায় বিক্রি করতেন। এভাবেই মা, ভাই, স্ত্রী ও দুই সন্তানের পরিবারের সংসার চলতো।

দোহাকুলা গ্রামের গহর শিকদারের ছেলে মানিক ২০১৭ সালে জাহাঙ্গীরকে চাকরির কথা বলে ভারতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। রাজিও হয়ে যান জাহাঙ্গীর। পরিবারের কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশ্যে। এরপর মানিক জাহাঙ্গীরকে নিয়ে খুলনার শিরোমনি এলাকার বাগুনবাড়িয়া গ্রামের মোসলেম মিঞার ছেলে মানবপাচারকারী ইলিয়াসের (মানিকের শ্যালক) কাছে পাঠিয়ে দেন। তার পরদিনই দালালের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরকে ভারতের মথুরা এলাকার দাউজিবাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে আগে থেকেই অবৈধভাবে বসবাস করছিল ইলিয়াসের পরিবার। ভারতে নির্মম নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে জাহাঙ্গীর তুলে ধরেন মর্মন্তুদ কাহিনী।

ভারতের মথুরা পর্ব
মথুরায় নিয়ে তাকে ভাঙারি সংগ্রহের কাজে লাগায় ইলিয়াসের পরিবার। সেখানে তাকে ময়লা-আবর্জনার মধ্য থেকে ভাঙাড়ি খুঁজে আনতে হতো। প্রতিদিন এক মণ (৪০ কেজি) ভাঙাড়ি না পেলে ইলিয়াসের স্ত্রী-সন্তান মিলে শুরু করতেন নির্যাতন। শরীরের বিভিন্ন স্থানে লোহার রড দিয়ে পেটানো হতো। সেদিন খেতেও দিতেন না তারা। এভাবেই কেটে যায় এক বছর।

জাহাঙ্গীর বলেন, ২০১৮ সালে একদিন রাতে দেখি ইলিয়াস, তার বউ, ছেলে ও মেয়ে একই ঘরে জোরে জোরে ঝগড়া করছে। একপর্যায়ে তিনজন মিলে ইলিয়াসের গলা টিপে ধরে। কিছুক্ষণ পর সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এরপর তিনজন মিলে ইলিয়াসকে ধরাধরি করে পাশের জঙ্গলে কবর দেয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমি দেখে ফেলেছি, এটা ওরা সন্দেহ করতে থাকে। আমাকে হত্যাচেষ্টাও করে ওরা। ব্যর্থ হয়ে আমাকে ইনজেকশনের মাধ্যমে অজ্ঞান করে ভারতীয় (মুম্বাইয়ের) দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। ভারতীয় দালাল অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। জ্ঞান ফিরলে দেখি সবকিছুই অপরিচিত। পরে জানতে পারি সাত লাখ টাকায় আমাকে লিবিয়ায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ভারতে অবস্থানকালে কোনো পারিশ্রমিকও দেওয়া হয়নি আমাকে।

এদিকে, নিখোঁজের সময় ইলিয়াসের পরিবার বলতো, জাহাঙ্গীর ভারতে একজনকে খুন করেছেন। তাই তিনি ভারতের কারাগারে বন্দি আছেন। কারাবাস শেষ হলেই দেশে ফিরবেন।

লিবিয়া পর্ব
লিবিয়ায় একটি শ্যাম্পু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে সুইপারের কাজ দেওয়া হয় জাহাঙ্গীরকে। থাকতে দেওয়া হয়েছিল শ্রমিকদের জন্য নির্মিত বোর্ডিংয়ে। সেই অন্ধকার ও নোংরা ঘরে ভালো লাগতো না তার। বিশাল কারখানার যাবতীয় নোংরা-আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাই ছিল দৈনন্দিন কাজ। প্রতিদিন নির্ধারিত কাজ শেষ করতে না পারলে শুরু হতো নির্যাতন। চড়-থাপ্পড়, লাথি, কিল, ঘুষি ছিল নৈমিত্তিক বিষয়। তিনবেলা খাবার ছাড়া জুটতো না আর কিছুই। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে পোশাক চেয়ে নিয়ে পরতে হতো তাকে। এসময় প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু জোটেনি কোনো স্বাস্থ্যসেবা। তারপরও পরিবারের কথা ভেবে নীরবে নির্যাতন সহ্য করেছেন তিনি। কিন্তু টাকার কথা বললে তারা জানাতেন দালালের কাছে সব দিয়ে দিয়েছেন। এভাবেই চলে প্রায় এক বছর। তিনি ভাবলেন, এভাবে চললে এক সময় সেখানেই মারা পড়বেন তিনি। তাই এক সময় পালানোর কথা ভাবতে লাগলেন জাহাঙ্গীর।

বাড়ি ফেরার পর্ব
সুযোগ বুঝে একদিন টহলরত লিবিয়া পুলিশের কাছে ধরা দেন জাহাঙ্গীর। নিজেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী পরিচয় দিয়ে বিস্তারিত বলেন পুলিশের কাছে। কয়েদখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। বিনা বিচারে চার বছর জেল খাটার পর লিবিয়া সরকার ভারতের মুম্বাই পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে জাহাঙ্গীরকে। মুম্বাইয়ের জেলখানায় তিনদিন অবস্থান করেন তিনি। এরপর তাকে কলকাতার দমদম জেলখানায় পাঠিয়ে দেয় মুম্বাই পুলিশ। ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে জাহাঙ্গীরকে সাতদিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন কলকাতার আদালত। জাহাঙ্গীরের কারাবাস শেষ হলে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে কলকাতা পুলিশ। এরপর গত ২ ডিসেম্বর সকালে গ্রামে ফেরেন জাহাঙ্গীর।

মায়ের কান্না
জাহাঙ্গীর যখন বাড়িতে ফেরেন তখন মা নবিরন নেছা ছিলেন না। কিছুক্ষণ পর বাড়িতে লোকজন দেখে তার কিছুটা ভয়ও হয়। কোনো অঘটন ঘটলো না-তো। পরে দেখেন রুগ্ন, এলোমেলো লম্বা চুল-দাড়িতে ভরা এক বৃদ্ধ একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে ঘিরে ধরে আছেন প্রতিবেশীরা। মুহূর্তে দৃষ্টি বিনিময় হয় মা-ছেলের। চিনতে পারেন না কেউ কাউকে। এরপর মা বুঝতে পারেন এই সেই হারিয়ে যাওয়া জাহাঙ্গীর। জড়িয়ে ধরে হাইমাউ করে কান্না শুরু করেন নবিরন নেছা।

মা নবিরন নেসা বলেন, আমার ছেলেকে আমিই চিনতে পারিনি। দেখে পাগলের মতো মনে হচ্ছিল। যারা আমার ছেলের এই অবস্থা করেছে তাদের বিচার চাই।

তিনি বলেন, আমার বসতবাড়ি (৪ শতাংশ জমি) ছাড়া আর কোনো জমাজমি নেই। অন্যের বাড়িতে বা রাস্তায় কাজ করে যা পাই তাই দিয়েই চলে সংসার। ছেলে শূন্য হাতে ফিরেছে এবং সে মানসিকভাবে অসুস্থ। তাকে চিকিৎসা করাতে হবে। ক্ষতিপূরণের মামলা করবো ওদের বিরুদ্ধে।

কিন্তু কীভাবে কার কাছে বিচার চাইবেন, কে দেবে আর্থিক সাহায্য তা জানেন না অসহায় মা নবিরন নেছা।

এ বিষয়ে বাঘারপাড়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ উদ্দীন জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীর অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মিলন রহমান/এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।