ইটভাটায় কয়লা সংকট, বিপাকে মালিক-শ্রমিকরা
কয়লা সংকট ও দাম বৃদ্ধির ফলে নারায়ণগঞ্জের ইটভাটাগুলোতে ইট তৈরি ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে বিপাকে পড়েছেন ইটভাটার মালিক ও ভাটায় কর্মরত শ্রমিকরা। কয়লার পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় অনেক ইটভাটাতে ইট পোড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রতিটন কয়লার দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ইটভাটার মালিকরা। ইটের দাম বৃদ্ধি করেও লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে দাবি তাদের। এর প্রভাব পড়ছে আবাসন খাতগুলোতেও।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট ২৯৪টি ইটের ভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি ইটভাটার লাইসেন্স রয়েছে।
সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ইট উৎপাদনে যান ভাটা মালিকরা। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মাটি কেনা, মাটি থেকে কাঁচা ইট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাঁচা ইট রোদে শুকিয়ে অক্টোবর মাসেই প্রথম কিস্তিতে ইট পোড়ানো শুরু করেন ভাটা মালিকরা।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন ইটভাটায় সরেজমিনে দেখা যায়, ভাটাগুলোতে শ্রমিকরা কাঁচা ইট তৈরিতে ব্যস্ত। কাঁচা ইটগুলো শুকানোর জন্য সারি সারি করে রাখা হয়েছে। তবে কয়লার উচ্চমূল্যের কারণে ইট পোড়ানোর কাজ ধীরগতিতে চলছে।
বিসমিল্লাহ ব্রিকসের মালিক আজিজুল হক আজিজ বলেন, আমাদের ইট ব্যবসা এখন বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে। আমাদের চার-পাঁচ মাসের লাভের টাকা দিয়ে এক বছর চলতে হয়। আমার ইটভাটাতে প্রায় ৪০০ পরিবার কাজ করে। তাদের মজুরি দেওয়ার পর আমাদের আর কিছু থাকে না। আগে প্রতি হাজার ইট ৯ হাজার টাকা করে বিক্রি করতাম আর বর্তমানে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করি। কয়লার দাম বৃদ্ধির ফলে ইট বেশি দামে বিক্রি করেও আমরা লাভের মুখ দেখছি না।
তিনি বলেন, দেশে পর্যাপ্ত কয়লা নেই। তার ওপর আবার ডলারের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব ইটভাটাগুলোতে পড়ছে। একটি ইট তৈরি করতে ৮০ শতাংশ খরচই কয়লার পেছনে চলে যায়। কয়লা ব্যবসাটা এখন দেশের বড় বড় শিল্পপতিরা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা লাইসেন্স করে বিদেশ থেকে একবারে ৫০-৬০ হাজার টন কয়লা কিনে নিয়ে আসেন। আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের তো একসঙ্গে এত কয়লা আনা সম্ভব না। আমাদের এসব শিল্পপতিদের কাছ থেকে কয়লা কিনতে হয়। বর্তমানে কয়লার এতটায় সংকট যে, গতবছর এক লাখ ইট তৈরির বিপরীতে ১০০ টন কয়লা পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। আর এ বছর তার অর্ধেক পরিমাণ কয়লাও পাচ্ছি না। আমার কাছে বর্তমানে যে কয়লা আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ দুইদিন ইট পোড়াতে পারবো। পরবর্তীকালে ইট তৈরি করতে কবে কয়লা পাবো তা এখন বলছে পারছি না।
ন্যাশনাল ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচারের মালিক শাফায়েত হোসেন বলেন, আমার বর্তমানে দুটি ইটের ভাটা রয়েছে। কয়লা সংকটের ফলে ভাটা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমার দুটি ইটভাটায় প্রতিমাসে প্রায় ৫০০ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। কয়লার দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার আমাদের খরচ অনেকে বেড়ে গেছে। ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে আমার দুটি ভাটার মধ্যে একটি বন্ধ করে দেবো। এভাবে চলতে থাকলে অনেক ইটভাটা বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে দেশে ভবিষ্যতে ইট সংকটও দেখা দিতে পারে।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাই একেবারে ছেড়েও দিতে পারছি না। কিন্তু যেভাবে কয়লার দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে এই ব্যবসা ধরে রাখাটা এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার সময়ও ব্যবসার অবস্থা এত খারাপ হয়নি, এখন যেমনটা চলছে।
কয়লা সংকটের বিষয়ে শাফায়েত বলেন, বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়ীরা এটিকে সিন্ডিকেট করে রেখেছে। কয়লার দামটা মূলত তারায় নিয়ন্ত্রণ করছে। আগে কয়লাগুলো ভারত থেকে আসতো। এখন কয়লাগুলো ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বেশি আসছে। তাই কয়লার দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এখন যে অবস্থা চলছে এর চেয়ে এই ব্যবসার পরিবর্তে অন্য ব্যবসায় চলে যাওয়া ভালো বলে মনে করি।
আবু সালেহ নামে এক ঠিকাদার বলেন, ইটের দাম বৃদ্ধির ফলে বাড়ি থেকে শুরু করে সবকিছুর নির্মাণ ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এর ফলে ফ্ল্যাটের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক বাড়ির মালিকরা এই দাম বৃদ্ধির কারণে বাড়ির নির্মাণ কাজ বন্ধ করে রেখেছেন। অনেকেই আর নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করছেন না।
নারায়ণগঞ্জ ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মমিন খান বলেন, দুই বছর আগেও প্রতি টন কয়লা আমরা সাত হাজার টাকায় কিনেছি। কিন্তু দুই বছরের ব্যবধানে টন প্রতি কয়লার দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩২ হাজার টাকা হয়েছে। কয়লা ব্যবসাটা এখন চলে গেছে বড়লোকদের হাতে। তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কয়লার দাম বেশি নিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, কয়লার দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ইটেরও দাম কয়েক দফায় বেড়েছে। এর ফলে আবাসন খাত থেকে শুরু করে সব প্রকল্পেরই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও পাবে। এছাড়া কয়লা সংকটের বিষয়টি সমাধান না হলে অচিরেই অনেক ইটভাটা বন্ধ হয়ে যাবে। এটির সঙ্গে দেশের ৮০ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। তাই সরকারের দ্রুত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
রাশেদুল ইসলাম রাজু/এমআরআর/এএসএম