গাইবান্ধার চরে যাতায়াতে একমাত্র ভরসা ঘোড়ার গাড়ি

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ০২:১০ পিএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০২২

গাইবান্ধার চরাঞ্চলের মানুষের কৃষিপণ্য পরিবহনে বাহন হিসেবে একমাত্র ভরসা ঘোড়ার গাড়ি। রাস্তাঘাট না থাকায় অধিকাংশ ঘোড়ার গাড়িচালকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছুটে বেড়াচ্ছে এ চর থেকে ওই চরে। ফলে চরের উৎপাদিত কৃষিপণ্য আনা-নেওয়ার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখছে এ ঘোড়ার গাড়ি।

তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদ-নদী কারণে একবারে বিচ্ছিন্ন গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি চার উপজেলার কামারজানি, চন্জিপুর, ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ি, ফুলছড়ি, উড়িয়া ও গজারিয়া ইউনিয়ন। এসব ইউনিয়নের খাটিয়ামারি, জিগাবাড়ি, পেপুলিয়া, গাবগাছি, গলনা, জিয়াডাঙ্গা, সাতারকান্দি, রসুলপুর, খাটিয়ামারি, ফুলছড়ি, টেংরাকান্দি, চর উত্তর খোলাবাড়ি, বাজে ফুলছড়ি, চর কালাসোনাসহ ১৬৫টি চর-দ্বীপচর এলাকায় কোনো যানবাহন চলাচল করে না। এ কারণে চরের প্রায় চার লাখ মানুষ বালুময় পথে মাইলের পর মাইল হেঁটে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতো। একই সঙ্গে তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য নিজের কাঁধে করে আনা-নেওয়া করতে হয়।

এসব উপজেলার চরাঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন প্রায় চার শতাধিক পরিবার। পানি কমে যাওয়ায় বর্তমানে তিস্তা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এখন মরুভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এতে এই উপজেলাগুলোর সাতারকান্দি, রসুলপুর, খাটিয়ামারি, ফুলছড়ি, টেংরাকান্দি, বাজে ফুলছড়িসহ চরের প্রায় চার লাখ মানুষের যাতায়াত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল ঘোড়ার গাড়িতে বহন করছে। এতে একদিকে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হয়েছে, অন্যদিকে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েছে চার শতাধিক পরিবার।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে নদ-নদী। শুকনো মৌসুমে চোখে পড়ে শুধুই বালুচর। জীবিকা রক্ষায় চরের মানুষ এই ঘোড়াগাড়ির উদ্ভাবন করেছে। মানুষের দুর্ভোগ অনেক কমেছে। এখন আর তপ্ত বালির ওপর দিয়ে হেঁটে দীর্ঘ চর পাড়ি দিতে হয় না। একই সঙ্গে দূর হয়েছে হাটবাজারে পণ্য নিয়ে যাওয়ার কষ্ট।

ব্রহ্মপুত্রের চরে ফুলছড়ি ঘাট এলাকায় ঘোড়াগাড়িচালক রবিউল ইসলাম বলেন, আমার বাড়ি ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া গ্রামে। ঘোড়াগাড়ি চালিয়ে প্রতিদিন আয় করি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। ঘোড়ার খাওয়ার জন্য প্রতিদিন খরচ হয় ২০০ টাকা। বাকি টাকা দিয়ে আমার সংসার ভালোই চলছে।

শুকনো মৌসুমে রবিউল ইসলামের মতো, আশরাফুল, মাইদুল, কালাম মিয়ার মতো আরও অনেকে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে আসেন তিস্তা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের চরে যাত্রী ও পণ্য বহনের জন্য। এসব এলাকায় ৪-৫ মাস চলে এই যাত্রী বহনের কাজ। মে মাসের মাঝামাঝি ব্রহ্মপুত্রে পানি এলে বন্ধ হয়ে যায় ঘোড়ার গাড়ি। তখন থেকে তারা আবার অপেক্ষায় থাকেন ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যাওয়ার।

কামারজানি ঘাটের ঘোড়াগাড়িচালক আশরাফুল ইসলাম (৩৬) বলেন, পাঁচ ভাই, দুই বোন ও মা-বাবা নিয়ে আমার সংসার। বাবা একা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তাই সংসারে সহযোগিতার জন্য একটি ঘোড়া কিনে দেন আমাকে। নিজেদের ফসল ঘরে তোলার ফাঁকে গাড়িতে অন্যদের ফসল এনে দিয়ে বাড়তি আয় শুরু করি। এভাবে সংসারে অভাব কমতে থাকে। পরে আরও তিনটি ঘোড়া কিনে ভাড়ায় খাটাতে শুরু করেন আমার বাবা। এতে আরও তিনজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। সব মিলিয়ে ভালোই কাটছে আমাদের দিন।

বালাশী ঘাটের ঘোড়ার গাড়ি চালক মাইদুল ইসলাম বলেন, ঘোড়ার গাড়ি তৈরিতে খরচ কম। ঘোড়ার দামও হাতের নাগালে। ৩০-৫০ হাজার টাকা হলেই মিলছে একটি ঘোড়া। কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে বেশ কয়েক বছর গাড়ি টানতে পারে ঘোড়াগুলো। তবে নিয়মিত প্রয়োজনীয় খাবার ঘোড়াকে খাওয়াতে হয়। সব মিলিয়ে ঘোড়া পালনে খরচও কম।

ঘোড়ার গাড়িতে করে কৃষি পণ্য নিয়ে আসছিলেন হরিচন্ডি চরের মতিন মন্ডল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, চরে তো কোনো রাস্তা-ঘাট নাই। কৃষি পণ্য পরিবহনে ঘোড়ার গাড়ির কোনো বিকল্প নেই। ঘোড়ার গাড়ি একমাত্র ভরসা আমাদের।

ফুলছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান জিএম সেলিম পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, ডিসেম্বর মাস থেকে মে মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রমত্ত তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে গিয়ে বিশাল চর জেগে ওঠে। এসময় নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চরের মানুষের কাছে ঘোড়ার গাড়ি যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে এসব এলাকার চার শতাধিক পরিবার ঘোড়াগাড়ি চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। এতে করে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।

জেএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।