রাজবাড়ী সদর

আশ্রয়ণের ঘর ভাড়া-বিক্রি, কোনোটিতে ঝুলছে তালা

রুবেলুর রহমান
রুবেলুর রহমান রুবেলুর রহমান , জেলা প্রতিনিধি রাজবাড়ী
প্রকাশিত: ০৬:২৯ পিএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০২২
রাজবাড়ী সদর উপজেলার আশ্রয়ণের একটি ঘরে ঝুলছে তালা। পাশে ঘর হস্তান্তর ও বিক্রয়নামা। ছবি-জাগো নিউজ

রাজবাড়ী সদরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাকাঘর পেয়েও অনেকে উপকারভোগী এ ঘরে থাকছেন না। এতে অযত্নে নষ্ট হচ্ছে ঘরগুলো। তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে এসব ঘর। অনেক ঘর বিক্রি ও ভাড়া দেওয়া হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের স্বজনরাও এ ঘর পেয়েছেন।

আশ্রয়ণের এসব ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। মেঝে ও দেওয়ালের পলেস্তারা উঠে যাওয়া, জানালা-দরজা ভালোভাবে না লাগা, টিনের স্ক্রু উঠে পানি পড়া, টিউবওয়েল ও রাস্তা না করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে উপকারভোগীদের।

রাজবাড়ী সদর উপজেলায় তিন ধাপে এখন পর্যন্ত ৫৪০টি আশ্রয়ণের ঘর উপকারভোগীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে আলীপুর ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ঘর রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে আলাদীপুর কোলনীতে ৭৬টি ঘর হস্তান্তর করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপকারভোগী শহিদুলের ১৮, ডালিম ১৯, শুকুর আলী ২৫ ও জাকিরের ২৬ নম্বর ঘরসহ বেশ কয়েকটি ঘর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

কল্যাণপুর বিলপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৯টি ঘরের মধ্যে জাহাঙ্গীর (৬ নম্বর ঘর) ও আকলির (১৬) ঘর দুটি ৫০০ টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে সাবেক ইউপি সদস্য মোস্তফার শ্যালিকার নামে ঘর বরাদ্দ হলেও তিনি থাকেন না।

কল্যাণপুর মধ্যপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২২টি ঘরের ৮-১০টি ঘরে কেউ থাকেন না। এরমধ্যে সাবেক ইউপি সদস্য সিদ্দিক ব্যাপারীর ছেলের নামে ঘর বরাদ্দ থাকলেও সেটি রয়েছে তালাবদ্ধ। এছাড়া এখানকার কয়েকটি ঘর বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।

পাঁচুরিয়া ব্রামণদিয়ায় ১৯টি ঘরের তিনটিতে কেউ থাকেন না। এখানে রওশনারা নামের এক নারী ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মরডাঙ্গায় আরেকটি ঘর পেয়েছেন তিনি। এছাড়া সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য লাইলির বোন পারভিনের নাম ঘর বরাদ্দ থাকলেও তিনি থাকেন অন্য জায়গায়।

আশ্রয়ন প্রকল্পের অনেক ঘরে শুরু থেকেই আসে নাই অনেক উপকারভোগী আবার অনেকে মাঝে মধ্যে এসে ঘর দেখাশুনা করে চলে যায়। তবে প্রকল্পগুলিতে রাস্তা ও টিউবওয়েল সমস্যা রয়েছে। এবং সামান্য বৃষ্টিতে পানি উঠে যায় ।

আলাদীপুর কোলনী গুচ্ছগ্রামের পারভিন খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার থাকার মতো কোনো ঘর ছিল না। এমনকী ঘরের জন্য আবেদন করেও পাইনি। এখন যে ১৯ নম্বর ঘরটিতে আছি এটি ডালিম নামের একজনের ঘর। তিনি ঘর পাওয়ার পর আর ঘরে ওঠেননি। একপর্যায়ে বিক্রির কথা বললে নগদ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে স্ট্যাম্প করে কিনে নিয়েছি।’

২৫ নম্বর ঘরে বসবাসকারী শেফালি বেগম বলেন, জহিরের বাবা শুকুর আলীর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকায় ৮ মাস আগে ঘরটি কিনেছি। তবে এখনো লিখে দেননি।

কল্যাণপুর বিলপাড়া গুচ্ছগ্রামের বাবলু বলেন, ঘর পাওয়ার পর তার ভাই গোয়ালন্দ মোড়ে জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন। যে কারণে এখানে আর আসেননি। ঘরটি এখন তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তিনি ভূমিহীন হওয়ায় এখানে একটি ঘর পেয়েছেন।

উপকারভোগী মিন্টু বলেন, ঘরগুলো অসহায় মানুষের পাওয়ার কথা থাকলেও যাদের জায়গা-জমি আছে তারা পেয়েছেন। এখানকার ১৯টি ঘরের দুটি ভাড়া দেওয়া। ৫-৬টি ঘরে কেউ থাকেন না।

তিনি আরও জানান, সাবেক ইউপি সদস্য মোস্তফার শ্যালিকা একটি ঘর পেয়েছেন। তবে ওই ঘরটিতে কেউ থাকেন না। বছরে একবার আসেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে কল্যাণপুর মধ্যপাড়া গুচ্ছগ্রামের দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখানকার ২২টি ঘরের ৮-১০টিতে কেউ থাকেন না। যাদের টাকা ও ঘরবাড়ি আছে তারা ঘর পেয়েছেন। কিন্তু যাদের জায়গা-জমি, টাকা-পয়সা কিছুই নেই তারা ঘর পাননি।’

তিনি আরও বলেন, ‘টিউবওয়েলগুলো ঘরের সামনে বসানোয় চলাফেরা ও রিকশা নিয়ে বের হওয়া যায় না। এটি বলার পরও এখনো অন্য পাশে টিউবওয়েল বসিয়ে দেননি।’

আলীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য সিদ্দিক ব্যাপারী বলেন, তার জমি-জমা কিছুই নেই। তার সম্পর্কে জেনেই তার ছেলে শাহিনকে একটি ঘর দেওয়া হয়েছে। তিনি তার স্ত্রী নিয়ে ওখানেই থাকতেন। কিন্তু স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় এখন আর ওই ঘরে থাকছেন না শাহিন। বাচ্চা প্রসব হলে আবার ওই ঘরে চলে যাবেন।


জানতে চাইলে পাঁচুরিয়া ইউনিয়নের সংরিক্ষত (১, ২ ও ৩) ওয়ার্ডের সদস্য লাইলি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বোনের কোনো জমিজমা নেই। যে কারণে সে ঘর পেয়েছে। বড় একটি মেয়ে থাকায় ওখানে থাকতে চায় না। এখন তার ভাসুরের ঘরে থাকে। তবে ওদের সব মালামাল ওই ঘরে আছে। মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া করে।’

তিনি বলেন, ‘কে কী বললো, সে অনুযায়ী আপনারা (সাংবাদিক) বললে তো হবে না। আর ঘর নিয়ে বসে থাকলে তো পেট চলবে না। যে কারণে সবসময় ওখানে থাকে না।’

ঘর বরাদ্দে অনিয়মের বিষয়ে আলীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, তিনি দ্বায়িত্ব পেয়েছেন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে। দ্বায়িত্ব পাওয়ার পর যে ঘরগুলো হস্তান্তর করেছেন, সেগুলোর বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই। তবে তিনি দ্বায়িত্ব পাওয়ার আগে যে ঘরগুলো হস্তান্তর হয়েছে, সেগুলো বিক্রি বা ঘরে কেউ থাকেন না বলে কিছু মৌখিক অভিযোগ পেয়েছেন। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে।

রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মার্জিয়া সুলতানা বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। তবে যে ঘরগুলোতে উপকারভোগীরা থাকছেন না, তাদের মনোনয়ন বাতিল করে নতুন উপকারভোগী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।

এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।