নকশিকাঁথায় স্বপ্ন বুনছেন দুই শতাধিক নারী

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ০৪:২৮ পিএম, ১৯ নভেম্বর ২০২২

নকশিকাঁথায় স্বপ্ন বুনছেন গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার দুই শতাধিক নারী। শুধু নান্দনিক নকশিকাঁথাই নয় এখানকার নারীরা শাড়ি, ওয়ান পিস, টু-পিস, থ্রি-পিস ও সালোয়ার কামিজসহ হাতের তৈরি বিভিন্ন ধরেনর পোশাক তৈরি করছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার উদয়সাগর এলাকার শেফালির বেগমের বাড়িতে অর্ধশত নারী নকশিকাঁথার কাজ করছেন। এদের মধ্যে কেউ বারান্দায়, কেউ উঠানে, আবার কেউ গাছ তলায় বসে শাড়ি, থ্রি-পিস ও সালোয়ার কামিজসহ বিভিন্ন পোশাকে আঁকছেন সুই আর রঙিন কারুকাজ। নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় একেকটি পোশাকে ফুটে উঠছে নান্দনিক সব নকশা। সুবিধা হইলো কর্মীরা নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েও নকশীকাঁথার কাজ করতে পারছেন।

কাজের ফাঁকে কথা হয় নারী কারিগরদের সঙ্গে। তারা জানান, কিছুদিন আগেও তাদের সংসারে অভাব ছিল। পরে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাপড়ের নকশার কাজ করায় এখন বাড়তি উপার্জন হচ্ছে। তারা প্রত্যেকই চাদর, শাড়ি ও জামায় কাজ করে মজুরি হিসেবে মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় করছেন।

নকশিকাঁথায় স্বপ্ন বুনছেন দুই শতাধিক নারী

উদয়সাগর এলাকার মমিনুল ইসলামের স্ত্রী সোহাগী বেগম (৩৬) জাগো নিউজকে বলেন, সপ্তাহে একদিনও আর বসে থাকতে হয় না আমাদের। পারিবারিক কাজের ফাঁকে এখানে কাজ করা যায়। এখানে কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করতে পারছি। নকশিকাঁথা তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছি।

একই এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী তানজিলা বেগম (৩৮) বলেন, এখান থেকে আয় করে তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। লেখা-পড়ার খরচ, বাড়ির বিদ্যুৎ বিলসহ ছেলে মেয়েদের আবদারসহ নিজের সখ পূরণ করতে পারছি।

নকশিকাঁথায় স্বপ্ন বুনছেন দুই শতাধিক নারী

নকশার কাজ করতে আসা পলাশবাড়ি সরকারি কলেজের স্নাতকের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না। তবে শেফালি আপার সঙ্গে কাজ করে আমার সেই দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি নকশিকাঁথার কাজ করে আয় করে পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারছি।

পলাশবাড়ি মহিলা ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আনিকা আক্তার বলেন, লেখাপড়ার খরচসহ নিজরে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে পারতেছি। এখন আর পরিবার থেকে টাকা পয়সা নিতে হয়না বরং এ আয় থেকে বিভিন্ন সময় পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারি।

নকশিকাঁথায় স্বপ্ন বুনছেন দুই শতাধিক নারী

উদ্যোক্তা সেফালি বেগম নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নিজে প্রশিক্ষণ নেওয়া পাশাপাশি গ্রামের ৭৫ জন নারী কর্মীকে বিআরডিবি থেকে প্রশিক্ষণ পাইয়ে দিয়েছেন। সেইসঙ্গে তার গ্রামের দুস্থ নারী ও শিক্ষার্থীদের আয়ের পথ তৈরি করেছেন।

বেসরকারি চাকরিজীবী স্বামী নিয়ে সংসারে সঙ্গে তিন সন্তান। এক সময় খরচের টাকার যোগান দিতে বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে সময় কাটানোর জন্য নিজের খেয়াল খুশি মতো তৈরি করেন একটি নকশিকাঁথা। সেই কাঁথা প্রতিবেশী এক নারী ১২০০ টাকায় তা কিনে নেয়ায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন তিনি। স্বজনদের সঙ্গে পুরোদমে কাজ শুরু করেন। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন নকশীর দুই শতাধিক সদস্যের এ পরিবার। স্বামী ও পরিবারের সকলের সহযোগিতায় দশ বছর ধরে কাজ করছেন শেফালি।

এখানে তৈরি হয় নকশিকাঁথার পাশাপাশি মেক্সি, বেবি টপ, ওড়না, শাড়ি, ওয়ান পিচ, টুপিচ থ্রি-পিস, বেডশিড, নকশি চাদর, কুশন, কভারসহ বিভিন্ন আধুনিক পণ্য। তার প্রতিষ্ঠানের তৈরি পোশাক ও নকশিকাঁথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা উদ্যোক্তারা তাকে চাহিদা পাঠাচ্ছে।

নকশিকাঁথায় স্বপ্ন বুনছেন দুই শতাধিক নারী

এ বিষয়ে নারী উদ্যোক্তা সেফালি বেগম জাগো নিউজকে বলেন, নিজের জন্য এবং গ্রামের অসহায় কর্মহীন নারীদের জন্য কিছু করতে পারাটা গর্বের বিষয়। বিআরডিবি প্রশিক্ষণ শেষে ঋণ নিয়ে সীমিত পরিসরে কাজ শুরু করি। আমার আজকের এ অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে আমার কারিগরদের। নকশিকাঁথার চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

গাইবান্ধা জেলা পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক আব্দুর সবুর জাগো নিউজকে বলেন, জেলায় অসহায়-কর্মহীন নারীদের স্বাবলম্বী ১৭ হাজার ৮২০ জনকে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এরমধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থানে যুক্ত আছে। আর প্রায় দেড় হাজার জন নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণসহ ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তাদের পাশে থাকাসহ সহায়তার সব ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানান তিনি।

গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) বাস্তবায়নে জেলায় ২২টি পণ্য ভিত্তিক পল্লি গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে জেলায় ৭টি নকশিকাঁথা পল্লি গড়ে তোলা হয়। এতে ১৮৭০ টি পরিবার এ কাজে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আরএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।