মোটা চাল আর ‘গরিবের’ নেই
বগুড়া রেলস্টেশনের পাশে বস্তির একটি টিনশেড ঘরে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন আজমল হোসেন। পেশায় রিকশাচালক। মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) সকালে ফতেহ আলী বাজারে চাল কিনতে যান তিনি। চার-পাঁচ দোকান ঘুরে কোথাও মোটা চাল পাচ্ছিলেন না। পরে একটি দোকানে মোটা চাল পান। ৫৮ টাকা দরে কেনেন পাঁচ কেজি।
আলাপকালে আজমল হোসেন বলেন, আগে যেকোনো মুদি দোকানে মোটা চাল পাওয়া যেত। কিন্তু এখন মুদি দোকানে মোটা চাল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে গিয়েও চালের বড় দোকান বা আড়তে মোটা চাল মেলে না, যা পাওয়া যায়, দাম বেশি রাখে। আবার বেশি দামের কারণে মাঝারি বা সরু চালে তো হাতই দেওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে নিম্নআয়ের মানুষকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
অধিকাংশ দোকানে টাকা দিয়েও মিলছে না মোটা চাল। হু হু করে বাড়ছে দাম। পাড়া-মহল্লার দোকানে মোটা চাল একেবারেই অপ্রতুল। চালের আড়ত কিংবা বড় বাজারেও সাত দোকান ঘুরে মিলছে এক দোকানে। এতে চরম বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ। বাধ্য হয়ে তারা বেশি দামে মাঝারি মানের চাল কিনছেন।
আড়তদাররা বলছেন, মিলাররা মোটা চাল সরবরাহ করছেন না। যাদের কাছে মিলছে দাম হাঁকছেন বেশি। অটোরাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আঙুল মজুতদারদের দিকে। এ সংকট কৃত্রিম হতে পারে বলে ধারণা তাদের। বগুড়ার কয়েকটি বাজার সরেজমিনে ঘুরে এ চিত্র মিলেছে।
ফতেহ আলী বাজারসহ রেললাইনের উত্তরপাশের বেশ কয়েকটি মুদি দোকানে চাল বিক্রি হয়। এর মধ্যে অনেক দোকানেই মোটা চাল (স্বর্ণা, চায়না, ইরি) দেখা যায়নি। দোকানিদের দাবি, বাজারে মোটা চালের সরবরাহ কম। তাই সংকট তৈরি হয়েছে। এতে অনেক দোকানি বাধ্য হয়ে কেজিতে দু-এক টাকা বাড়িয়ে চাল বিক্রি করছেন। নিরুপায় হয়ে নিম্নআয়ের মানুষ মাঝারি মানের চাল কিনছেন। বাজারে মাঝারি ও সরু চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
মিলারদের কারসাজিতে বাজারে মোটা চালের সংকট দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন চাল ব্যবসায়ী আব্দুল হালিম সরকার। তিনি বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে বাজারে চালের সংকট তৈরি করেন মিলাররা। এখন মাঝারি ও সরু চাল বাজারে পাওয়া গেলেও মোটা চালের সংকট রয়েছে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে মোটা চাল নেই বললেই চলে। কিছু দোকানে মিললেও প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকায়। অথচ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, টানানো বাজারদরে মোটা চাল পাইকারি ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা এবং খুচরায় ৪৭ থেকে ৫০ টাকা।
বগুড়া শহরের মধ্যে খান্দার বাজার, গোদারপাড়া বাজার, মালতিনগর বউবাজার, বকশিবাজার, কলোনীবাজার, সেউজগাড়ি বাজার, নামাজগড় বাজার, কালীতলা বাজারসহ কয়েকশ পাইকারি ও খুচরা চালের আড়ত বা দোকান রয়েছে। সম্প্রতি এই বাজারগুলোয়ও মোটা চালের সংকট দেখা গেছে।
মালগ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আমির আলী। গত সোমবার বিকেলে মোটা চাল কিনতে খান্দার বাজারে যান। কিন্তু অনেক ঘোরার পর একটি দোকানে পান মোটা চাল। ৫৬ টাকা দরে ১০ কেজি চাল কেনেন। ফেরার পথে আলাপকালে আমির আলী বলেন, আগে মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে চাইলেই মোটা চাল পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বলে বাজারে মোটা চাল নেই। আবার মাঝারি বা সরু চাল কিনে খাওয়ার মতো সাধ্যও নেই। তাই বাজারে চাল কিনতে এসেছি। অনেক খুঁজে একটি দোকানে পেলাম। বাজারে মোটা চাল কেন পাওয়া যাচ্ছে না, এ উত্তর কেউ দিতে পারেননি।
ওই বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই বাজারে চাল সরবরাহ করেন মিলাররা। তাদের কাছে মোটা চাল চাইলে বলে, চাল নেই।
তিনি বলেন, গত আমন, বোরো, ইরি মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু তারপরও বাজারে চালের সংকট। মাঝারি ও সরু চাল বেশি দামে কিনতে গিয়ে কর্মহীন, নিম্নআয়ের মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।
ফতেহ আলী বাজার থেকে ১০ কেজি মাঝারি চাল (পাইজাম) কেনেন মাসুদ রানা। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন মালতিনগর এলাকায়। আলাপকালে বলেন, দিন যত যাচ্ছে, সংসারে ব্যয় তত বাড়ছে। আর এই ব্যয়ের বড় একটি খাত চাল। তারপরও বাজারে মোটা চাল পাওয়া যায় না।
গোদারপাড়া বাজার থেকে বগুড়ার অধিকাংশ মুদি দোকানি চাল কেনেন। দেখা যায়, এই বাজারের প্রতিটি দোকানেই কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নির্ধারিত চালের দাম উল্লেখ করে বোর্ড টাঙানো। সেখানে মোটা চালের দাম লেখা আছে ৪৪ টাকা কেজি। তবে অধিকাংশ দোকানে মোটা চাল দেখা যায়নি।
বউবাজার এলাকার মুদি দোকানি আব্বাস মিয়া। দিনে তার দোকানে তিন বস্তা চাল বিক্রি হয়। এর মধ্যে মোটা চালের চাহিদা বেশি বলে জানান। তিনি বলেন, ক্রেতাদের চাহিদা থাকলেও গত এক-দুই মাস ধরে আড়তে মোটা চাল পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে দুই-চার বস্তা মোটা চাল পেলেও দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অনেক দরিদ্র মানুষ বাধ্য হয়ে মাঝারি বা সরু চাল কিনছেন।
গোদারপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী আমিনুল বলেন, বর্তমান বাজারে মোটা চাল নেই বললেই চলে। আগে মোটা যে চালের কেজি ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকা তা বর্তমানে পাইকারিতে ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে।
‘সরকারের কাছে অনুরোধ আমরা তিন বেলা খেতে চাই’
চালের দাম দফায় দফায় বাড়লেও আয় বাড়েনি কর্মজীবীদের। ধারদেনায় জর্জরিত বেশির ভাগ মধ্যবিত্তের হিসাবের খাতা। বাজারে চাল কিনতে এসে দামে না কুলানোর কারণে প্রয়োজনের চেয়ে কম চাল কিনেন গৃহবধূ আলেয়া জাহান মৌ। স্বামী বেসরকারি চাকরি করেন। কিন্তু দিনের অপরিহার্য খাদ্য উপাদান চালের দাম বাড়লেও বেতন বাড়েনি। চিকন চালের জায়গায় এখন খান মোটা চাল। কখনো কখনো তাও দুবেলা।
মনে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা আগে খেতাম কাটারিভোগ চাল, প্রত্যেক মাসে চালের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে এখন মোটা চাল খাই। আমাদের চেয়ে যারা আরও সাধারণ তারা কীভাবে আছে? চালের দাম বাড়ার জন্য যারা আগে তিনবেলা খেতো তারা এখন দুবেলা ভাত খায়। আমরা তিনবেলা খেতে চাই। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ আমরা যাতে তিনবেলা খেতে পাই সেই ব্যবস্থা যেন করে সরকার।
আলেয়ার মতো কুলসুম বেওয়াও পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ছেলের রিকশা আর নিজের রাস্তার ধারে পিঠার দোকান থাকলেও সংসারে চালের যোগান দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে তার জন্য। তিনি বলেন, বাজারে চালের দাম বেশি। কিনতে গেলে দাম ছাড়ে না। ব্যবসায় পড়তা হয় না, খুব কষ্টে আছি আমরা।
বাসা-বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন রহিমা খাতুন। চাল কিনতে এসে বিপাকে পড়েন। কারণ প্রতি কেজিতে তিন-চার টাকা বেশি দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে তাকে। তিনি বলেন, অপারেশন করার পর দিনে আড়াইশ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। কিন্তু বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। এখনো কোনো ভাতা কার্ড পাইনি। মানুষের বাড়িতে কাজ করে খেতে হয়। কাজের দামও বাড়েনি। এতে খুব কষ্ট হয়ে গেছে।
বগুড়ার পাইকারি চালের বাজার গোদারপাড়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চিকন চালের দাম না বাড়লেও মোটা চালের মধ্যে রঞ্জিতের দাম পাইকারি কেজিতে তিন টাকা এবং খুচরায় পাঁচ টাকা বেড়েছে। গেলো সপ্তাহে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি এই চাল বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা দরে যা বর্তমানে ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে ২৫ কেজির বি-আর ২৮ চালের বস্তা গেলো সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৩৫০ টাকায় যা এই সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ অর্ধেক মণের প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ১০০ টাকা।
বগুড়া চারমাথা এলাকায় গোদারপাড়া বাজারের মেসার্স শাহ চাল ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী এবং জেলা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহ মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, সপ্তাহ নয় গেলো এক মাস ধরে চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত মাসে যে চাল কিনতে পেরেছিলাম প্রতি কেজি ৫৪ টাকায় কিন্তু এ মাসের শুরুতে সেই চাল কিনতে হচ্ছে ৫৮ টাকায়।
তিনি বলেন, মিলাররা দাম বাড়ালে আমাদেরও দাম বাড়াতে হচ্ছে। মিলারদের কাছে পর্যাপ্ত চাল মজুত আছে। তারা যদি দেশের মানুষের কথা মাথায় রেখে দাম না বাড়ায় তাহলে ভালো। এজন্য বেশি বেশি বাজার মনিটরিং করতে হবে।
তবে মেসার্স মায়া মনির অটোরাইস মিলের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান মিজান বলেন, চালের বাজার অস্থির নয়। ধানের দাম বেশি তাই চালের দাম বেশি। প্রতি মণ ধানের দাম আগে ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। এখন দাম ১ হাজার ৭০০ টাকা। তাই চালের দাম আগে ৫৫ টাকা ছিল এখন ৬০ টাকা কেজি।
ধানের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধানের বীজের দাম বেশি, তেলের দাম বেশি এমনকি সারের দামও অনেক বেশি। এজন্য ধানের দামও বেশি।
ধানের দাম বৃদ্ধিতে কালোবাজারি মজুতদাররাই দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ধান ১৫ দিনের জন্যও মজুত রাখি না। ধানের স্টক ব্যবসা যারা করে তাদের ধরেন। তাদের জন্যই ধানের দাম বাড়ে। এ কালোবাজারিরাই হাজার হাজার মণ ধান মজুত করেন।
এমআরআর/এমএস