জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

পানিশূন্যতায় ধুঁকছে বিল, দেশি মাছের আকাল

আমিন ইসলাম জুয়েল আমিন ইসলাম জুয়েল , জেলা প্রতিনিধি ,পাবনা
প্রকাশিত: ০৪:০৪ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০২২
দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে পাবনার মুক্ত জলাশয়ের বাহারি মাছ

পাবনার মুক্ত জলাশয় বা বিলের বাহারি জাতের মাছ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এর সঙ্গে চায়না দোয়ারি জালের দাপটে রেণু পোনা পর্যন্ত উজাড় হচ্ছে। এতে স্থানীয় হাট-বাজারে খুব কমই দেখা মিলছে চিরচেনা দেশি প্রজাতির মাছ, যা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোও আকারে খুব ছোট। পাবনার চলনবিলসহ জেলার সব বিলাঞ্চলেই একই অবস্থা। যদিও মৎস্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশি মাছ সংরক্ষণে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পাবনার বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে দেশি প্রজাতির বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, চিতল, রিটা, গুজি, আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু মাছ এখন আর তেমন চোখে পড়েনি। দেশি সরপুঁটি, গজার, বাইম, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘাইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালবাউশ, শোল, তারা বাইম, বেলেসহ ৪০-৫০ জাতের মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। পুকুরে চাষ করা হাইব্রিড মাছে সয়লাব বাজার। যেসব পুকুরে একসময় দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত, সেসব পুকুরে এখন বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে মিঠা পানির দেশি প্রজাতির মাছের স্থান দখল করেছে পুকুরে উৎপাদিত হাইব্রিড মাছ। বাজারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় চাষ করা পাঙ্গাশ।

স্থানীয়রা জানান, সাধারণত বর্ষা মৌসুমে দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলসহ পাবনার অন্যান্য বিল এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। ছোট-বড় সব নালা, খালও পানিতে ভরপুর থাকে। তবে এবার প্রাকৃতিক কারণে ভরা বর্ষা ঋতুতেও পরিমাণ মতো বৃষ্টি হয়নি। ফলে বিলগুলোতে পর্যাপ্ত পানি আসেনি। যার প্রভাব পড়েছে বিলের মাছের ওপর। ক্রেতারা হন্য হয়ে খুঁজেও চাহিদামতো দেশি প্রজাতির মাছ পাচ্ছেন না। হাইব্রিড মাছেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। বিলের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

প্রবীণরা জানান, অতীতে চলনবিলসহ পাবনার সব বিল বর্ষা মৌসুমে পানিতে ভরপুর থাকতো। উঁচু জমিতে ফসল আবাদ আর নদী-খালে মাছ শিকার চলতো। প্রকৃতির বৈরী আচরণ, অপরিকল্পিত স্থাপনা ও বাঁধ নির্মাণে বিলগুলোতে এখন পানি কম। চলতি বর্ষা মৌসুমে পানিশূন্যতায় ধুঁকছে বৃহৎ চলনবিলসহ পাবনার অন্যান্য ছোট-বড় সব বিল। তাই মুক্ত জলাশয়ের সুস্বাদু মাছের দেখা মিলছে না।

পাবনার অন্যতম বড় একটি বিল গ্যারকাবিল। সেই বিলপাড়ের বাসিন্দা আ. রশিদ, শফিকুল ইসলাম ও জালাল উদ্দিন জানান, এবার বিলে পানি খুবই কম। এজন্য মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। তারা বিলপাড়ের বাসিন্দা হয়েও মাছ পাচ্ছেন না।

jagonews24

বিলগ্যারকা পাড়ের ইসলামপুর গ্রামের মৎস্যজীবী মনির হোসেন জানান, বিলে এবার গত বছরের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ পানি কম। ফলে তারা খুব কম মাছ পাচ্ছেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আর দুই মাস পরে বিলে হয়তো মাছই পাওয়া যাবে না।

আরেক মৎস্যজীবী রানা মোল্লা জানান, গত বছরের তুলনায় এবার বিলে ৭-৮ হাত পানি কম। এত কম পানি থাকায় মাছের উৎপাদনও কম হয়েছে। তারা বিলে খুবই কম মাছ পাচ্ছেন।

জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলনবিল অধ্যুষিত পাবনা জেলা থেকে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তির পথে ৩০ প্রজাতির মাছ। এক সময় একশো প্রজাতির ওপর মাছ পাওয়া যেত জেলায়। সময়ের পরিবর্তনে নদীর পাড় দখল, বিলের মাঝ দিয়ে রাস্তা নির্মাণ, অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন, অধিক ফলনের আশায় জমিতে কীটনাশক প্রয়োগসহ নানা কারণে হারিয়ে যেতে থাকে বিভিন্ন দেশি প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ।

jagonews24

জেলা মৎস্য অফিস থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, পাবনায় ১০৬টি খাল রয়েছে। এর দ্বিগুণ পরিমাণে ২১২টি বিল রয়েছে। প্রায় ৩৭ হাজার পুকুর রয়েছে। ২৩৩টি প্লাবনভূমি রয়েছে। ৬৩৫টি বড়পিট (বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংলগ্ন খাল), আটটি মৎস্য অভয়াশ্রম রয়েছে। জেলায় ২১ হাজারের বেশি মাছ চাষি রয়েছেন। মৎস্যজীবী বা জেলের সংখ্যা ৩৪ হাজারের বেশি। জেলায় প্রতি বছর গড়ে ৬৮ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ছয় হাজার টনের বেশি মাছ উদ্বৃত্ত থাকে।

সুজানগর উপজেলার বিল গাজনা পাড় এলাকার চিনাখড়া বাজারের মাছের আড়তদার আ. লতিফ জানান, তারা সিলভার কার্প, পাঙ্গাশ ছাড়াও পুকুরে চাষ করা রুই, কাতলা, মৃগেল, কই, মাগুর স্থানীয় মাছ চাষিদের কাছ থেকে কিনে পাইকারি বাজারে বিক্রি করেন। এখন টেংরা, পাবদাসহ দেশি প্রজাতির বেশকিছু মাছ পুকুরেই চাষ হচ্ছে। চাষিরা সম্পূরক খাবার খাইয়ে এসব মাছ বড় করেন।

তিনি বলেন, দেশি প্রজাতির মাছের চাহিদা বেশি, এগুলোর দামও বেশি। তবে এসব মাছ বেশি পাওয়া যায় না। দেশি প্রজাতির মাছ বিক্রি শেষ হওয়ার পরই কেবল হাইব্রিড জাতের মাছ বিক্রি হয়।

jagonews24

এক প্রশ্নের জবাবে লতিফ বলেন, বেশ কয়েক বছর থেকে বিলে মাছের অভাব দেখা দিয়েছে। এবার বিলে পানি কম থাকায় দেশি জাতের মাছের খুবই অভাব।

সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে দেশি মাছ কিনতে আসা মোকাদ্দেছ মোল্লা (৭০) বলেন, বাজারে তো আগের মতো দেশি জাতের মাছ নেই। বিলে পানি নেই, তাই মাছ কম। যে মাছ আছে সেগুলোও চায়না দোয়ারি জাল দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, একেবারে ছোট ছোট মাছ ধরছে জেলেরা। এখন পোনাসহ মা মাছ ধরছেন তারা। কিন্তু দু-এক মাস পরে তো বিলে মাছই পাওয়া যাবে না। কারণ এখন চায়না দোয়ারি জাল দিয়ে তারা মাছ ছেঁকে নিয়ে আসছে।

বাজারে মাছ কিনতে এসে একই রকম কথা বলেন সাঁথিয়া উপজেলার শোলাবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণলাল কর্মকার। তিনি বলেন, এখন বিলের মাছ খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে। বিলে পানি কম, সেজন্য মাছও কম। কিন্তু যেগুলো আছে সেগুলোও চায়না দোয়ারি জালের মতো সুক্ষ্ম জাল দিয়ে মেরে নির্বংশ করা হচ্ছে।

বনগ্রাম ফাউন্ডেশনের সভাপতি কে এম ফিরোজ হোসেন বলেন, সামাজিক উদাসীনতার কারণেও বিলের মাছ নষ্ট হচ্ছে। কারণ চায়না দোয়ারি জাল বন্ধ করতে হলে স্থানীয় জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ জাল ব্যবহার বন্ধ হবে না। পাবনায় এত পরিমাণ বিল রয়েছে যে, মৎস্য অফিসার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা এসিল্যান্ডরা যদি অফিসের সব কাজ বাদ দিয়ে শুধু প্রতিদিন একটি করে বিলে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালান তাও প্রতি উপজেলায় মাসে মাত্র একটা বিলে যাওয়া সম্ভব হবে। তাই চায়না দোয়ারি জাল ব্যবহার ও বিক্রি বন্ধে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাহিদুল ইসলাম বলেন, গত ৮০ বছরের মধ্যে পাবনায় এবার সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে পানি কম হওয়ায় খাল-বিলে এবার মাছ কম। মুক্ত জলাশয়ে মাছ কমার জন্য মানবসৃষ্ট কিছু কারণও রয়েছে। এখন এলাকার ছোট ছোট খাল-বিলে বাঁধ দিয়ে বা ঘের বানিয়ে অনেকে মাছ চাষ করেন। সেটা লিজ নিয়ে হোক বা জবরদখল করে হোক। এতে মুক্ত জলাশয়কে আবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে।

jagonews24

তিনি বলেন, বিলের বা মুক্ত জলাশয়ের প্রাকৃতিক মাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বিচরণ করে। কিন্তু তা রুদ্ধ করে ফেলায় মাছের প্রজনন বিঘ্নিত এবং প্রজনন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতে দেশি জাতের সব মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।

ড. রাহিদুল আরও বলেন, অদূর ভবিষ্যতে জেলায় আমিষের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এছাড়া মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি নানা জলজ সম্পদও বিলুপ্ত হতে পারে। ফলে প্রকৃতি হারাতে পারে ভারসাম্য। এজন্য কারেন্ট জাল, চায়না দোয়ারি জাল ব্যবহার বন্ধ করা, প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ না ধরা, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ না করা, জলাশয় সংলগ্ন রাসায়নিক সারের ব্যবহার রোধসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

এ বিষয়ে পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাছ উৎপাদনে পাবনা জেলা এগিয়ে। এ জেলা থেকে উৎপাদিত মাছ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়। প্রায় হারিয়ে যাওয়া বহু প্রজাতির মাছ এখন পুকুরে চাষ করা হচ্ছে। মাছ চাষে বিপ্লব ঘটেছে পাবনায়। এজন্য তারা বহু মাছ চাষিকে প্রশিক্ষিত করেছেন।

তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কিছু কারণে মুক্ত জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ কমে গেছে। এবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি কমের কারণে বিলগুলোতে পানি কম। বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে মা মাছ নিধনের ফলেও বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি মাছ। কিছু অসাধু ব্যক্তি এখন চায়না দোয়ারি জাল ব্যবহার করছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিদিনই অভিযান চলছে।

এমআরআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।