ঝিনাইদহে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে স্কুল ফাঁকির প্রবণতা
স্কুল ফাঁকি দেওয়া সেই আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে। কিন্তু বিষয়টি যখন অভ্যাসে পরিণত হয় তখন তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। দিনের পর দিন স্কুল-কলেজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে অনেকেই। এই সময় বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্র কিংবা নির্জন স্থানে বন্ধুর সঙ্গে তারা মত্ত হচ্ছে আড্ডায়। কখনো আবার বহিরাগতরাও যোগ দিচ্ছে তাদের সঙ্গে, যা কিশোর অপরাধসহ বিভিন্ন সামাজিক শঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। সম্প্রতি স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ভর-দুপুরে তাদের স্কুলে থাকার কথা থাকলেও ব্যাগ রেখে আড্ডা দিচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে। ক্যামেরা দেখেই লুকানোর চেষ্টা করে কেউ কেউ। এমন দৃশ্য ঝিনাইদহ সদর উপজেলা পরিষদের পুকুর পাড় এলাকায় প্রতিদিন চোখে পড়ে। এভাবে শহরের ধোপাঘাটা ব্রিজ, দেবদার চত্বর, তামান্না পার্ক, জোহান পার্ক, উপজেলা পরিষদ পুকুরপাড়সহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে হরহামেশাই দেখা মেলে স্কুল ড্রেস পরে ব্যাগ ঘাড়ে ছাত্রছাত্রীরা একান্তে সময় কাটাচ্ছে। কেউ বা ঘনিষ্ঠতায় আবদ্ধ হচ্ছে। কোথাও কোথাও বিড়ি-সিগারেটের নেশায়ও মত্ত হচ্ছে তারা। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ হচ্ছে বহিরাগতরাও।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মাহামুদ বলেন, নদীর ওপারে যখন পার্কের কাজ শুরু হয় আমরা খুশি হয়েছিলাম যে, নদীর ধারে লোকজন প্রাকৃতিক পরিবেশের ছোয়া পাবে। কিন্তু পরে দেখছি সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এখানে বিভিন্ন ছেলেমেয়েদের আনাগোনা। অনেক সময় ছেলেমেয়েদের আপত্তিকর অবস্থায়ও আমরা দেখতে পাই। আমরা নদীর এপারে যারা বসবাস করি আমাদের কাছে এটা খুবই দৃষ্টিকটু দেখায়। এতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক অভিভাবক বলেন, আমার বাচ্চা কোথায় যাচ্ছে, স্কুলে আসছে কি না; এটা দেখার আমাদের যেমন দায়িত্ব আছে; স্কুল কর্তৃপক্ষেরও তো একটা দায়িত্ব আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে তাহলে তো কোনো বাচ্চারা বাইরে যাওয়ার কথা না। অভিভাবকরা স্কুলে বাচ্চাকে দিয়ে চলে যান। কেউ চাকরি করে, কেউ ব্যবসা করে এ কারণে তারা এখানে থাকতে পারে না। বাচ্চাদের খোঁজ-খবর নিতে পারি না। এছাড়া বাচ্চা নিয়ে এসে তিন ঘণ্টা স্কুলে বসে থাকাও তো সম্ভব না।
ঝিনাইদহ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলে, আমার বাবা সরকারি চাকরি করেন। তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে থাকেন। আর আমিও বাইরে থাকি। আমার স্কুল-কোচিং থাকে এজন্য বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাসায় ফিরে রেস্ট নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসার সময়ই শুধু বাবা-মায়ের সঙ্গে একটু কথা হয়। তা ছাড়া আর সুযোগ হয় না। বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে মন চায় কিন্তু তাদের তো সময়ই হয় না।
অপর এক শিক্ষার্থী বলে, অনেক ভোরবেলা কোচিংয়ের জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। কোচিং শেষ করে স্কুলে চলে যাই। স্কুল শেষে হলে আবারও একটি কোচিংয়ে পড়তে যাই। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর বাসায় ফিরে স্কুলের পড়া করতে রাত একটা থেকে দেড়টা বেজে যায়। পরিবারের সঙ্গে সেভাবে সময় দেওয়া হয় না। আর আমার বাবা থাকেন দেশের বাইরে। তাকে তো বছরে একদিনও পাই না। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়। আর মা ছোট ভাইটাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
ঝিনাইদহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা লহ্মী রানী পোদ্দার বলেন, আমাদের কিছু মেয়েরা দেখা যাচ্ছে নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসছে না। তাদের খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা যাচ্ছে তারা বিভিন্নভাবে স্কুল ফাঁকি দিচ্ছে। একপর্যায়ে অভিভাবকদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তাদের ডেকে আনছি এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের জ্ঞাতসারেই স্মার্টফোন ব্যবহার করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মেয়েরা স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে আসার নাম করে বাসা থেকে বের হয়ে। পর স্কুলে না এসে তারা বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং স্কুল টাইম শেষে তারা বাসায় ফিরছে। এদের পড়াশোনা হচ্ছে না, মেধাবিকাশও হচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার জন্য বলছি।
ঝিনাইদহ কাঞ্চননগর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমার বিশ্বাস বলেন, বর্তমান কিছু শিক্ষার্থীরা স্কুল ড্রেস পরে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। আমার প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী সেসব স্থানে আমার টিম পাঠাই। এ বিষয়ে আমরা বাবা-মাকে জানালে তারা আমাদের বলেন, আমার সন্তান স্কুলে গেছে এমনটা করতেই পারে না। অনেকে আবার আমাদের খারাপ নজরে দেখে তাদের সন্তানকে নিয়ে কেন এ ধরনের কথা বলছি।
অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক আমিনুর রহমান টুকু বলেন, আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মূল্যবোধের অভাব। একই সঙ্গে পারিবারিক শিক্ষারও অভাব যে কারণে অনেক সময় তারা বিপথগামী হয়ে যায়। তারা বিভিন্ন খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। এজন্যই এদের মাঝে পারিবারিক শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন। সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়েদের যে পরিমাণ সময় দেওয়া দরকার বাবা-মারা বিভিন্ন কারণে সন্তানদের সেই সময়টুক দিচ্ছে না। যার কারণে তাদের মধ্যে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এজন্যই আমাদের সন্তানদের সময় দিতে হবে, তাহলে তারা বিপথগামী হবে না।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দপ্তরের চিকিৎসক ডা. অলিউর রহমান বলেন, ছেলেমেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক, শারীরিক নানা পরিবর্তন হয়। ফলে বিষণ্ণতা, অমনোযোগিতাসহ নানা সমস্যায় পড়ে। এ থেকে উত্তরণে অভিভাবকদের সন্তানের প্রতি যত্নবান হতে হবে। সেইসঙ্গে শিক্ষকদের নিয়মিত কাউন্সিলিং করতে হবে।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম বলেন, ছেলেমেয়েরা স্কুল চলাকালে ক্লাস না করে স্কুল ড্রেস পরিহিত অবস্থায় পার্ক বা বিভিন্ন স্থানে বসে আড্ডা দিচ্ছে এ বিষয়টি আসলে খুবই দুঃখজনক। এই অভিযোগটি আমরা পাচ্ছি। এ বিষয়ে আমরা অভিভাবকদের নিয়ে একটি মিটিং করে তারা যেন তাদের সন্তানদেরকে স্কুলমুখী করেন এবং নজরদারি করেন এমন একটি মেসেজ দেবো। এরপরও যদি স্কুল চলাকালে ড্রেস পরিহিত অবস্থায় কোনো শিক্ষার্থীকে কোনো স্থানে আড্ডা দিতে দেখা যায় আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবো।
এমআরআর/জিকেএস