পঞ্চগড়ে নৌকাডুবি
৬০ জনের ধারণক্ষমতার নৌকাটিতে যাত্রী ছিলেন ‘দেড় শতাধিক’
পঞ্চগড়ের বোদায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় জেলাজুড়ে এখন শুধুই স্বজন হারানোর আজাহারি। কেউ স্বজনের মরদেহের পাশে বসে কাঁদছেন, আবার কেউ নিখোঁজ স্বজনের সন্ধানের প্রহর গুনছেন।
সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে দিনব্যাপী ক্ষণে ক্ষণে নতুন মরদেহের সন্ধান মিলছে। বেড়েই চলেছে লাশের সারি। এ পর্যন্ত ৫১ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অর্ধশতাধিক। নিখোঁজদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।
সোমবার সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আগের দিন উদ্ধার করা হয় ২৪ জনের মরদেহ।
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, মৃত ৪৯ জনের পরিচয় নিশ্চিত করে তার তালিকা প্রকাশ করেছে জেলা প্রশাসনের জরুরি তথ্যকেন্দ্র। তালিকায় দেখা গেছে, মৃতের বেশিরভাগই সনাতন ধর্মাবলম্বী।
যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে
নৌকাডুবিতে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে হাশেম আলী (৭০), শ্যামলী রানি (১৪), লক্ষ্মী রানি (২৫), অমল চন্দ্র (৩৫), শোভা রানি (২৭), দিপঙ্কর (৩), পিয়ন্ত (আড়াই বছর), রুপালি ওরফে খুকি রানি (৩৫), প্রমিলা রানি (৫৫), ধনবালা (৬০), সুনিতা রানি (৬০), ফাল্গুনী (৪৫), প্রমিলা দেবী, জ্যোতিশ চন্দ্র (৫৫), তারা রানি (২৫), সানেকা রানি (৬০), সফলতা রানি (৪০), বিলাশ চন্দ্র (৪৫), শ্যামলী রানি ওরফে শিমুলি (৩৫), উশোশি (৮), তনুশ্রী (৫), ব্রজেন্দ্র নাথ (৫৫), ঝর্ণা রানী (৪৫), দীপ বাবু (১০), সুচিত্রা (২২), কবিতা রানী (৫০), বেজ্যে বালা (৫০), দিপশিখা রানী (১০), সুব্রত (২), জগদীশ (৩৫), যতি মিম্রয় (১৫), গেন্দা রানী, কনিকা রানী, আদুরী (৫০), পুষ্পা রানী, প্রতিমা রানী (৫০), সূর্যনাথ বর্মন (১২), হরিকেশর বর্মন (৪৫), নিখিল চন্দ্র (৬০), সুশীল চন্দ্র (৬৫), যুথি রানী (১), রাজমোহন অধিকারী (৬৫), রূপালী রানী (৩৮), প্রদীপ রায় (৩০) এবং পারুল রানীর (৩২) নাম জানা গেছে। তাদের সবার বাড়ি পঞ্চগড়ে।
রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালয়া উপলক্ষে আউলিয়া ঘাট থেকে একটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন যাত্রীরা। ঘাট থেকে নৌকাটি কিছু দূর যাওয়ার পরই ডুবে যায়।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর অপর পাড়ে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজা উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। রোববার দুপুরের দিকে মূলত ওই ধর্মসভায় যোগ দিতে সনাতন ধর্মালম্বীরা নৌকাযোগে নদী পার হচ্ছিলেন। তবে ৫০-৬০ জনের ধারণ ক্ষমতার নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিলেন।
অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নদীর মাঝপথে নৌকাটি ডুবে যায়। অনেকে সাঁতার জানায় তীরে আসতে পারলেও সাঁতার না জানা নারী ও শিশুরা ডুবে যান। ধারণা করা হচ্ছে, স্রোতের কারণে অনেক মরদেহ পানিতে ভেসে গেছে।
নৌকাডুবি থেকে বেঁচে যাওয়া মাড়েয়া বামনপাড়া এলাকার সুবাস চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমিও নৌকায় ছিলাম। নৌকায় দেড়শরও বেশি যাত্রী ছিল। আমরা ওঠার পরপরই নৌকায় পানি ঢুকতে শুরু করে। এ সময় মানুষজন নৌকার মধ্যেই হুড়োহুড়ি শুরু করে। পরে যে পাশেই যাচ্ছিলাম, সেপাশেই পানি ঢুকছিল। আমরা পাঁচজন বন্ধু ছিলাম। কোনোমতে সাঁতার কেটে প্রাণে বেঁচে যাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্য যাত্রীরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি করছিল। কিন্তু চরম মুহূর্তের বর্ণনা করতে পারবো না। এত মানুষ মারা যাবে, বুঝতে পারিনি।’
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় জানান, মরদেহ সৎকারের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। দুর্ঘটনায় আহতদের পাঁচ হাজার করে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) জহুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এ জেলার ইতিহাসে ভয়াবহ ট্রলারডুবি এটি। এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে ট্রলারডুবির খবর শুনে ছুটে আসেন রেলমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন। করতোয়া নদী পারাপারের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে ইংরেজি বর্ণ ‘ওয়াই’ আকৃতির ব্রিজের কাজ দ্রুত শুরু হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন মন্ত্রী।
সফিকুল ইসলাম /এসআর/জিকেএস