করতোয়ায় নৌকাডুবি: একে অন্যকে জড়িয়ে বাঁচার আকুতি করছিল যাত্রীরা
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিতে এখন পর্যন্ত নারী-শিশুসহ ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন নৌকার প্রায় অর্ধশত যাত্রী।
এদিকে, নৌকা ডুবি থেকে বেঁচে যাওয়া সুবাস চন্দ্র রায় নামে এক যাত্রী ওই ভয়াবহ সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমিও নৌকায় ছিলাম। নৌকায় দেড়শোও বেশি যাত্রী ছিল। আমরা নৌকায় ওঠার পরপরই পানি ঢুকতে শুরু করে। এসময় মানুষজন নৌকার মধ্যেই হুড়োহুড়ি শুরু করে। পরে যে পাশেই যাচ্ছিলাম, সেপাশেই নৌকায় পানি ঢুকছিল। আমরা পাঁচজন বন্ধু ছিলাম। কোনোমতে সাঁতার কেটে প্রাণে বেঁচে যাই। অন্য যাত্রীরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি করছিল। ওই মুহূর্তের অবস্থা বর্ণনা করার মতো না। তবে এত মানুষ মারা যাবে, তা বুঝতে পারিনি।
রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরের এই ঘটনায় রাত ৮টার পরও উদ্ধার কাজ চলছিল। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা।
এরই মধ্যে উদ্ধারদের মরদেহ শনাক্ত করেছেন স্বজনরা। নিহতরা হলেন- পলি রানী (১৪), লক্ষী রানী (২৫), অমল চন্দ্র (৩৫) শোভা রানী (২৭), দিপঙ্কর (৫), প্রিয়ান্তা রানী (৫), খুকি রানী (৩৫), প্রলিমা রানী (৫৫), তারা রানী (২৪), শোনেকা রানী (৬০), ফাল্গুনি রানী (৫৫), প্রমিলা রানী (৭০), ধনবালা (৪৭), সুমিত্রা রানী (৫৭), সফলতা রানী (৪০), শিমলা রানী (৩৫), নৌকার মাঝি হাসান আলী (৫২), উশোষী রানী (২), তনুশ্রি রানী (২), শ্রেয়শী রানী (২), বিমল চন্দ্র (৪৫), শ্যামলি রানী (৩৫), জোতিষ চন্দ্র (৫৫) রূপালি রানী (৩৫)। তাদের মধ্যে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা নদী থেকে ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করেন এবং বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেওয়ার পথে আরও আটজন মারা যান। নিহতদের মধ্যে আটজন শিশু, ১২ জন নারী এবং চার জন পুরুষ। তাদের বাড়ি জেলার বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।
এদিকে, ঘটনার পর জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সফিকুল ইসলামসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিটের উদ্ধার কাজ পর্যবেক্ষণ করেন।
পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদে জরুরি তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। মরদেহ শনাক্তসহ যে কোনো প্রয়োজনে ০১৭০৮-৩৯৭৭১৮ ও ০১৭১৯-৩৪৭১৭৩ এই নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। নিহত সদস্যের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর পাড়ে বদ্বেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজা উপলক্ষে প্রতিবছর ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। রোববার দুপুরের দিকে মূলত ওই ধর্মসভায় যোগ দিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে নদী পার হচ্ছিলেন। তবে ৫০ থেকে ৬০ জনের ধারণ ক্ষমতার নৌকাটিতে প্রায় দুইশো যাত্রী ছিল। অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নদীর মাঝপথে নৌকাটি ডুবে যায়। তখন অনেকে সাঁতরে তীরে আসতে পারলেও সাঁতার না জানা বিশেষ করে নারী ও শিশুরা পানিতে ডুবে যায়।
রংপুর বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এখন পর্যন্ত ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো অনেক নৌকার যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের উদ্ধার না করা পর্যন্ত আমাদের কাজ অব্যাহত থাকবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যাই। এখনো পর্যন্ত উদ্ধারকাজ চলছে। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে তাৎক্ষণিক দেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনায় একটি তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে আরও মরদেহ উদ্ধার হতে পারে।
সফিকুল ইসলাম/এমআরআর/জিকেএস