দিনাজপুরে ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি

আজও প্রতিশ্রুতি পানে চেয়ে আছেন সেদিনের হতাহতরা

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি দিনাজপুর
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ এএম, ২৪ আগস্ট ২০২২
ইয়াসমিনের ছবি হাতে মা শরীফা বেগম

আজ ২৪ আগস্ট। ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরে কয়েকজন বিপথগামী পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল কিশোরী ইয়াসমিন। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল দিনাজপুরের সর্বস্তরের জনতা। প্রতিবাদী জনতার ওপর ২৭ আগস্ট পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। নিহত হন সামু, সিরাজ, কাদেরসহ ৭ জন, আহত হন ৩ শতাধিক। সেই থেকেই দিনাজপুরসহ সারা দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।

দীর্ঘ ২৬ বছরে ইয়াসমিন, সামু, সিরাজ, কাদেরসহ নিহতদের পরিবারগুলো সরকারিভাবে তেমন সুযোগ-সুবিধা পায়নি। নিহত সামু, সিরাজ, কাদেরের স্ত্রীদের তৎকালীন বিএনপি সরকার চাকরির প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট। দীর্ঘদিন পর মাকে দেখার জন্য আকুল হয়ে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাড়ি ফিরছিল কিশোরী ইয়াসমিন। কিন্তু দিনাজপুরের কোচে না উঠতে পেরে সে পঞ্চগড়গামী একটি কোচে ওঠায় কোচের লোকজন তাকে দিনাজপুরের দশমাইল নামক স্থানে নামিয়ে দিয়ে সেখানকার এক চা দোকানির জিম্মায় দেয়। নিরাপদ ও রক্ষক ভেবে ইয়াসমিনকে দিনাজপুর শহরে মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাকডাকা ভোরে পুলিশের হাতে তুলে দেয় দশমাইলের লোকজন।

কিন্তু পথে দশমাইলের অদূরে সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে পুলিশ। এরপর পুলিশ ইয়াসমিনের মরদেহ শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ব্র্যাক অফিসের পাশে রাস্তায় ফেলে চলে যায়।

পরদিন পুলিশের এই পৈশাচিক ঘটনা জানাজানি হলে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। কিন্তু তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে উল্টো নিষ্পাপ কিশোরী ইয়াসমিনকে যৌনকর্মী হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে। এ ঘটনায় আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দিনাজপুরের প্রতিবাদী জনতা। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ।

বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর লাঠিচার্জ করে। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ২৬ আগস্ট রাতে বিক্ষুব্ধ জনতা কোতোয়ালি থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকলে পুলিশ আবারও তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এ সময় হাজার হাজার মানুষ কোতোয়ালি থানার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলে। ২৭ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা রাজপথে নেমে আসে। সব প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি এবং দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবিতে জনতার বিশাল মিছিল বের হলে পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে সামু, কাদের ও সিরাজসহ ৭ জন নিহত হন, আহত হন ৩ শতাধিক প্রতিবাদী মানুষ।

পরে বিক্ষুব্ধ জনগণ শহরের ৪টি পুলিশ ফাঁড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিক্ষোভের এই সুযোগ নিয়ে কতিপয় স্বার্থান্বেষী ও দুষ্কৃতকারী দিনাজপুর প্রেস ক্লাবসহ স্থানীয় ৫টি পত্রিকা অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দিনাজপুর শহরে কারফিউ জারি করা হয়। টানা ৩ দিন চলে কারফিউ।

আজও প্রতিশ্রুতি পানে চেয়ে আছেন সেদিনের হতাহতরা

তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেবসহ শহরের গোটা পুলিশ সদস্যদের ক্লোজ করা হলে শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে তৎকালীন বিডিআর বাহিনী। পরে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক জব্বার ফারুককেও প্রত্যাহার করা হয়।

এ ঘটনায় তৎকালীন দিনাজপুর সিআইডি জোনের সিনিয়র এএসপি আফজাল হোসেন বাদী হয়ে পুলিশের এএসআই ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পিকআপ ভ্যানের চালক কনস্টেবল অমৃত লালকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলাটি পুলিশের সিনিয়র এএসপি মাহফুজুর রহমান তদন্ত করে এজাহার নামীয় ৩ জন আসামি এএসআই ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার, পিকআপ ভ্যানচালক কনস্টেবল অমৃতলাল, তৎকালীন দিনাজপুরের পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ওসি এসআই মাহতাব উদ্দীন, এএসআই স্বপন কুমার, এসআই মতিয়ার রহমান, এএসআই জাহাঙ্গীর আলম ও ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার মহসিনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে ইয়াসমিন হত্যা মামলাটি দিনাজপুর থেকে স্থানান্তর করা হয় রংপুরে।

ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি ৩টি আদালতে ১২৩ দিন বিচার কাজ শেষে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে আসামি এএসআই মঈনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান ‘৯৫-এর ৬ (৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হয়। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় এএসআই মঈনুলকে আরো ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

অপরদিকে দণ্ডবিধির ২০১/৩৪ ধারায় আলামত নষ্ট, সত্য গোপন, অসহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি দিনাজপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, ডা. মহসীন, এসআই মাহতাব, এসআই স্বপন চক্রবর্তী, এসআই জাহাঙ্গীর, এএসআই মতিয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দেন।

আজও প্রতিশ্রুতি পানে চেয়ে আছেন সেদিনের হতাহতরা

চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় ৮ বছর পর অর্থাৎ ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত ১২টা ১মিনিটে মামলার অন্যতম আসামি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার বিশ্রামপাড়ার জসিমউদ্দীনের ছেলে এএসআই মইনুল হক, নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার চন্দনখানা গ্রামের এসএম খতিবুর রহমানের ছেলে কনস্টেবল আব্দুস সাত্তারকে রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিটে মামলার অপর আসামি নীলফামারী সদর উপজেলার রাজপুর গ্রামের লক্ষ্মীকান্ত বর্মনের ছেলে পুলিশের পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মনকে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।

আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলি ও টিয়ার শেলের আঘাতে গুরুতর আহত হন দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার ইসমাইল হোসেনের ছেলে মাসুদ রানা (৫৫)।

তিনি বলেন, ২৭ আগস্ট কয়েক হাজার আন্দোলনকারী একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি জেলা কারাগারের সামনে পৌঁছালে পুলিশ লিলিমোড় থেকে অতর্কিত গুলি ছোড়ে। এসময় আমি জেল রোডের মোটরসাইকেলের দোকানে মোটরসাইকেল মেরামতের কাজ করছিলাম। পুলিশের ছোড়া একটি গুলি আমার বাম কানের কাছে লাগে। পরে আশপাশের লোকজন আমাকে উদ্ধার করে দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালের কাছে নিয়ে গেলে হাসপাতালের সামনে পৌরসভার সামনে থেকে আরেক দল পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। টিয়ার শেলের আঘাতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পুলিশের গুলি ও টিয়াল শেলের আঘাতে আহত হয়ে আমি প্রায় ৯ মাস হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুরে এসে নিহত ও আহত পরিবারকে সহায়তা ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহায়তা পাইনি। আমি বর্তমানে বাহাদুর বাজারে একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করি। ঠিকমতো কাজও করতে পারি না। হামলায় আহত হলাম অথচ আজ পর্যন্ত আমার কেউ খোঁজ নিল না। শুধু আমিই না আমার মতো বহুজন আহত হয়ে খুব কষ্টে দিন যাপন করছে। বছর ঘুরে আসে, নেতারা দিবস উপলক্ষে ভাষণ দেন। কিন্তু আমাদের ব্যাপারে কেউ চিন্তা করে না।

আজও প্রতিশ্রুতি পানে চেয়ে আছেন সেদিনের হতাহতরা

দিনাজপুর মহিলা পরিষদের সভাপতি কানিজ রহমান বলেন, আজ সারাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হলেও দিনাজপুরে পালিত হচ্ছে ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি। ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির ২৬ বছরেও সমাজে নারীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মূলত আইনের সঠিক প্রয়োগ ও আইনের বিভিন্ন ফাঁক ফোকড় দিয়ে দ্রুত জামিনে বের হয়ে যাওয়ায় নারীর প্রতি নির্যাতন বেড়েছে। দ্রুত বিচার করা হলে সমাজে নারী নির্যাতন অনেকটা কমে যাবে বলে আমি মনে করি।

ইয়াসমিন হত্যা ও বিচারের দাবিতে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন দিনাজপুর-১ আসনের এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপাল। তিনি বলেন, ইয়াসমিন হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনায় যে আন্দোলন হয়েছিল তা পুরো দিনাজপুরবাসীর অবদান। যখন দিনাজপুরে তীব্রতর আন্দোলন চলছে, অচল হয়ে পড়েছে, ঠিক সেই সময় আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনাজপুরে এসেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত আন্দোলনটি ছিল নারী নির্যাতনের একটি মাইলফলক। আন্দোলনে দিনাজপুরবাসীর সম্মান, মর্যাদা রক্ষার একটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছিল।

দিবসটি উপলক্ষে ইয়াসমিন স্মৃতি পরিষদ আয়োজিত দশমাইলের সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া ইয়াসমিনের কবর জিয়ারত, দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

অপরদিকে ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগম ২৪ আগস্ট তার বাড়িতে দুস্থ্যদের মাঝে খাদ্য বিতরণ ও দোয়ার আয়োজন করেছেন।

ইয়াসমিনকে স্মরণ রেখে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আজ দিনাজপুরের বিভিন্ন সংগঠন ইয়াসমিনের কবর জিয়ারত, দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।

এমদাদুল হক মিলন/এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।