গো-খাদ্য ও জ্বালানির চড়া দামে সংকটে দুগ্ধ শিল্প
খামারিদের প্রতি লিটার দুধ উৎপাদনে খরচ পড়ে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। কিন্তু প্রতি লিটার দুধের দাম পাওয়া যাচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা। এরমধ্যে গত দু’ সপ্তাহে নাগালের বাইরে চলে গেছে গোখাদ্যের দাম। এ অবস্থায় বহু খামারি গাভী পালন বাদ দিয়েছেন।
বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি এখন চাহিদা অনুপাতে দুধ পাচ্ছে না। তাদের মতে দুগ্ধ উৎপাদনকারী, দুধ সরবরাহকারী, ভোক্তা, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান সবাই একটি সংকটের মধ্যে রয়েছে।
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার দুগ্ধ সমবায় সমিতির ম্যানেজার হযরত আলী জানান, দুগ্ধ উৎপাদন খামারিদের ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে যে গমের ভূষি ছিল ১৪০০-১৫০০ টাকা বস্তা (৩৪- ৩৫ কেজি) এখন তা ১৮০০ টাকা বস্তা হয়ে গেছে। খুচরা প্রতি কেজি ৫৫- ৫৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খড় বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ টাকা মণ (৩৫ কেজিতে মণ ধরা হয়)। এভাবে দফায় দফায় গো খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে খামারিদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আরেক দফা খাদ্যের দাম বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দুধ পরিবহনের খরচও বেড়ে গেছে।
তিনি নিজে দুধের ব্যবসার পাশাপশি গো খাদ্যের দোকান পরিচালনা করেন। দাম কম দেওয়ার কারণে মিল্ক ভিটায় তারা দুধ দিতে পারছেন না। একে তো দামে পোষাচ্ছে না তার উপর পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা স্থানীয় ঘোষ, মিষ্টি, ছানা ও ঘি ব্যবসায়ীদের কাছে দুধ বিক্রি করছেন। এতে কিছুটা লাভ থাকছে।
তিনি জানান, স্থানীয় বাজারগুলোতে এখন গড়ে ৫০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি হচ্ছে। গো খাদ্য কিনে চাষিরা পোষাতে পারছেন না। অনেক ক্ষুদ্র চাষি আছেন যারা দু’ একটা গাভী পালন করেন তারা নিজেরাই ঘাস কেটে গাভীকে খাওয়ান। নিজে অন্য কাজের পাশপাশি গাভীকে ঘাস কেটে খাওয়ান বলে কিছুটা লাভ দেখতে পান। কিন্তু নিজের পারিশ্রমিক বাদ দিলে তাদের লাভ বলে কিছু থাকে না।
খামারি ও ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার আগে খামারি ও দুধ ব্যবসায়ীরা মোটামুটিভাবে টিকে ছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে বিধি-নিষেধ শুরু হলে দুগ্ধ শিল্পে বিপর্যয় দেখা দেয়। গত দুই বছরে খামারিরা লোকসান দিলেও করোনা পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তারা কিছুটা লাভবান হতে থাকেন। কারণ এ সময়ের মধ্যে দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধের দামও দু’ দফায় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মাসখানেক হলো গোখাদ্যের দাম আবার বেড়ে যায়। আর গত কয়েকদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আরেক দফা দাম বেড়েছে, পরিবহন খরচ বেড়েছে। ফলে দুগ্ধ শিল্পে মহামন্দা দেখা দিয়েছে।
বেড়া পৌর সদরের বৃশালিখা মহল্লার খামারি আবদুল মোমিন বলেন, তার খামারে ১২টি গাভী ছিল। মাসখানেক আগে তিনি সব বিক্রি করে দিয়েছেন।
তিনি জানান, গো-খাদ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় প্রতিটি গাভীর পেছনে দৈনিক ২০০-২৫০ টাকা লোকসান হচ্ছিল। আবার দুধের দামও ঠিকমতো পাচ্ছিলেন না। তাই গরু বিক্রিতে বাধ্য হয়েছেন।
ফরিদপুর উপজেলার দুধ ব্যবসায়ী মোহর আলী জানান, দুধের খুচরা বাজারে প্রতি মণের দাম ২০০০-২১০০ টাকা (প্রতি লিটার প্রায় ৫০ টাকা)। তিনি মিল্ক ভিটায় দুধ দিতেন। কিন্তু সেখানে দুধ সরবরাহ করে দুধের কেনা দামই ওঠে না ।
তিনি জানান, খামারিদের কাছ থেকেই পাইকারি ৪৫-৪৬ টাকা লিটার দরে দুধ কিনতে হয়। অথচ মিল্কভিটা লিটারে ৫ টাকা দাম বাড়ানোর পরেও দাম হচ্ছে ৪৪-৪৫ টাকা লিটার। কিন্তু বিভিন্ন খাতে আবার ৩ টাকা বাদ যায়। তাহলে নিট দাম দাঁড়ায় ৪১-৪২ টাকা লিটার। এর উপর পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। তাই মিল্ক ভিটায় তিনি আর এখন দুধ দেন না।
বেশ কিছু খামারি অভিযোগ করে বলেন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই খামারিদের দুধ বিক্রি করার প্রধান ভরসা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান দুধের সঠিক দাম দিচ্ছে না। এর ওপর চাহিদা কমে যাওয়ার অজুহাতে এসব প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনাও ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে শুরু করেছে। খামারিদের দাবি প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ে ৪৪-৪৫ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে দাম দিচ্ছে তাতে তাদের পোষাচ্ছে না।
সরকারি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটার আওতাধীন সাঁথিয়া উপজেলার বোয়ালমারি প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি বেলায়েত হোসেন জানান, তার সমিতিতে খামারি রয়েছেন ১৩২ জন। গরু নিয়ে সমিতির সদস্যরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। সমিতির সদস্যদের লোকসান যাচ্ছে। তারা দুধের দাম বেশি পাচ্ছেন না। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ৩৫০ টাকা মণ খড়ের দাম হয়েছে ৫০০ টাকা, ৩৩ টাকা কেজি দরের গমের ভুসি হয়েছে ৫৬ টাকা।
সাঁথিয়ার পোরাট দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি ফজলুর রহমান জানান, গাভী লালন-পালন করা অনেক কষ্টের ব্যাপার। তার খাবার প্রস্তুত করে খাওয়ানো, পরিচর্যা, দুধ দোহন করা, গোয়াল পরিষ্কার, গাভীর গোসল সবই সময় ও শ্রমের ব্যাপার। এসব নেপথ্য শ্রম ধরলে আর খাবারের দাম বাদ দিলে লাভের পরিমাণ থাকে না বললেই চলে।
তিনি জানান, গো খাদ্যের দাম অনুপাতে দুধের নায্য দাম তারা পাচ্ছেন না। পরিবহনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে দুধ উৎপাদনের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে খামারি বা চাষিরা আর লাভবান হচ্ছেন না।
তিনি বলেন, সরকার অনেক কিছুতে ভর্তুকি দেয়। গো-খাদ্য কেনার জন্য প্রকৃত খামারিদের ভর্তুকি দিলে ক্রেতা ও ভোক্তা উভয়েই উপকৃত হতেন।
এদিকে দুগ্ধশিল্পের এ দুরাবস্থায় পাবনার অনেক ছোট খাট দুধ ব্যবসায়ীসহ দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার আমাইকোলা গ্রামের ইছামতী ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্ট (পিউরা মিল্ক) ও তানিয়া ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্ট (সেইফ মিল্ক) নামের প্রতিষ্ঠান।
পিউরা মিল্কের মালিক আবদুর রউফ বলেন, তার কারখানায় ৫০ জন শ্রমিক ছিল। প্রতিদিন তিনি ঢাকায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার লিটার দুধ সরবরাহ করতেন। কারখানা চালাতে গিয়ে প্রতিদিন ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত মাথার ওপর প্রায় ২৫ লাখ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে মাসখানেক হলো কারখানাটি বন্ধ করে দিয়েছেন।
আমাইকোলা মহল্লায় মাসুদ সেখ জানান, সরকারি অনুমোদন নিয়ে ‘তানিয়া ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্ট’ নামে একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কারখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি দুই কোটিরও বেশি টাকা বিনিয়োগ করেন। তার কারখানায় ৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে ‘সেইফ মিল্ক’ নামে প্যাকেটজাত করে ঢাকার বাজারে সরবরাহ করতেন তিনি। ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা লোকসানের পর কারখানাটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
মাসুদ সেখ জানান, এখন বিশাল অংকের ঋণের বোঝা নিয়ে আর্থিক কষ্টে রয়েছেন। একই সঙ্গে কারখানার ৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দুধ সরবরাহে যুক্ত আড়াইশ ব্যবসায়ীও বিপাকে পড়েছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত মাসুদ শেখ জানান, ৬০-৭০ লাখ নগদ অর্থই শুধু লোকসান হয়নি কারখানার যন্ত্রগুলোও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় তা নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে হিসাবে করলে লোকসান দুই কোটি টাকা বলে জানান তিনি।
দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে সরকার অনুমোদিত ১৪টি দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সরকারি মিল্কভিটাসহ বেসরকারি প্রাণ ডেইরির প্রাণ মিল্ক, ব্র্যাকের আড়ং দুধ, আকিজের ফার্ম ফ্রেস মিল্ক উল্লেখযোগ্য। এগুলোর বেশির ভাগেরই পাবনায় দুধ সংগ্রহকেন্দ্র রয়েছে।
বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটার উপমহাব্যবস্থাপক সাইদুল ইসলাম বলেন, মাসখানেক আগে তাদের প্রতিদিন সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার লিটারের কাছাকাছি। তাদের তালিকাভুক্ত খামারিদের (সদস্য) উৎপাদিত সব দুধই তারা নেন। তবে এই মৌসুমে দুধের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে আসায় তাদের সংগ্রহ কম হচ্ছে।
বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটার মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন, অর্থ ও নিরীক্ষা) ডা. মাহফুজুল ইসলাম জানান, তাদের চাহিদা অনুপাতে দুধ পাচ্ছেন না। মিল্কভিটা দুধের দাম বাড়িয়েছে। এর উপর পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ অন্যান্য স্থানে সরবরাহ খরচ বেড়ে গেছে।
তিনি জানান, দাম সমন্বয় করতে গেলে শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ঘাড়েই দাম বৃদ্ধির বোঝা পড়ে। সবকিছু মিলিয়ে দুগ্ধ সংগ্রহকারী, উৎপাদক, ভোক্তা সবার জন্যই একটা সংকট চলছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলে দুধের উৎপাদন বাড়লে সমস্যা কমবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানান, পাবনায় কাঁচা ঘাসের প্রাচুর্য রয়েছে। জেলায় প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘাস চাষ করা হয়। তবে দানাদার খাদ্যের দাম কিছুটা বেশি। সেটাতে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারে তার স্থানীয়ভাবে কিছু করার নেই। এটা নীতি নির্ধারকদের বিবেচনার বিষয়।
বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ লিটারের বেশি দুধ উৎপাদন হয়। দুগ্ধ উৎপাদনকারীরা পাবনার ভাঙ্গুড়া ক্রয় কেন্দ্র, সিরাজগঞ্জের লাহিড়ী মোহনপুর ও বাঘাবাড়ী মিল্কভিটায় প্রতিদিন দুধ সরবরাহ করেন। এ অঞ্চলে প্রায় এক হাজার দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমিতির মাধ্যমে এ দুধ সরবরাহ হয়। সমিতিভুক্ত মোট সদস্যের সংখ্যা ৫০ হাজার। সমিতির বাইরেও কয়েক হাজার খামারি মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহ করে থাকেন। এছাড়া প্রতিদিন ৭৫ থেকে ৮০ হাজার লিটার বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান এবং ঘোষরা ২৮ থেকে ২৯ হাজার লিটার দুধ কিনে থাকেন।
এফএ/এএসএম