মাটিরাঙ্গার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহীদ মিনার শূন্য
মহান ভাষা আন্দোলনের ৬৩ বছর পরেও খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো শহীদ মিনার। সরকারের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, পদক্ষেপ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, ভাষার প্রতি শ্রদ্ধার অভাব ও খামখেয়ালিপনার কারণে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আজও গড়ে ওঠেনি স্বপ্নের শহীদ মিনার। ফলে মহান ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও এর ইতিহাস ও গুরুত্ব সর্ম্পকে ধারণা নেয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি জনপদের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। প্রাপ্ত তথ্যমতে মাটিরাঙ্গা উপজেলার ৯৪ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই কোনো শহীদ মিনার।
শহীদ মিনার না থাকা কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই নিজেদের উদ্যোগে কলা গাছ পুঁতে, বাঁশ, কাঠ ও কাগজ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়ে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। তাও আবার কদাচিৎ। আবার কেউ কেউ নিজেদের উপজেলা পর্যায়ের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ব করে। কেউ কেউ সরকারি ছুটি হিসেবেও দিনটি পালন করে থাকে বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। এছাড়াও উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পালিত হয় না মাতৃভাষা দিবসের কোনো কর্মসূচি।
এদিকে, উপজেলা পর্যায়ে এ দিবসে শোভাযাত্রা আর শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আলোচনা সভার আয়োজন করা হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে কোনো আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় না। ফলে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে অনেকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলায় সরকারি ৮৪টি সরকারিসহ ১০৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর বাইরেও বেসরকারি, বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন রয়েছে ২০টিরও বেশি। যেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ বিদ্যালয়েই কোনো শহীদ মিনার নেই।
সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, মাটিরাঙ্গা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভবানীচরণ রোয়াজাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিলাশ্যাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে। মাটিরাঙ্গা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি শহীদ মিনার থাকলেও তা প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে শহীদ মিনারটি ইতিমধ্যে তার সৌন্দর্য হারিয়ে বখাটেদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মাটিরাঙ্গা উপজেলায় দুইটি কলেজ, ২৫টি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১০টি মাদরাসা রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই সরকারি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এখনো স্থাপিত হয়নি ভাষা আন্দোলনের অর্জন শহীদ মিনার।
মাটিরাঙ্গা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তবলছড়ি গ্রীনহিল কলেজে নেই কোনো শহীদ মিনার। খোদ মাধ্যমিক পর্যায়ে মাটিরাঙ্গার `মাদার` শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত মাটিরাঙ্গা পাইলট হাইস্কুলে কোনো শহীদ মিনার নেই। শহীদ মিনার নেই মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রশাসনের নাগের ডগায় অবস্থিত এবং উপজেলার একমাত্র নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাটিরাঙ্গা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মাটিরাঙ্গা ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা ও মাটিরাঙ্গা পৌরসভা পরিচালিত একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাটিরাঙ্গা মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে। শহীদ মিনার নেই জামায়াত ইসলামী নিয়ন্ত্রিত মাটিরাঙ্গা রেসিডেন্সিয়াল হাইস্কুলেও। ফলে এখানে অধ্যয়নরত হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভুলে যেতে বসেছে শহীদ মিনারের ইতিহাস।
শহীদ মিনার না থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ শহীদ মিনার থাকার গুরুত্ব অনুধাবন করে জানায়, সরকারি বা স্থানীয়ভাবে প্রয়োজনীয় বরাদ্ধ না পাওয়ায় শহীদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। মাটিরাঙ্গা পৌরসভার কাউন্সিলর মো. আলাউদ্দিন লিটন, মনে করেন প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্থানীয়ভাবে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। তার মতে শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের বার্তা বহন করে।
স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, শহীদ মিনার না থাকার কারণে দুর্গম পাহাড়ি জনপদের প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ থাকে মাতৃভাষা দিবসসহ নানা জাতীয় দিবসে বন্ধ থাকে। ফলে নীরবে নিভৃতেই পেরিয়ে যায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো তাৎপর্যপূর্ণ একটি মহান দিন। বিদ্যালয় কেন্দ্রিক কোনো কর্মসূচির আয়োজন না করায় এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা থেকে পিছিয়ে পড়েছে।
মাটিরাঙ্গা পৌরসভার নব-নির্বাচিত মেয়র ও মাটিরাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শামছুল হক উপজেলার বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না থাকায় নিজের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করে বলেন, ভাষা আন্দোলন আমাদের মহান স্বাধীনতার সূতিকাগার। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে না জানলে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হবে আমাদের আগামী প্রজন্ম। তিনি পৌরসভার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেবেন বলেও জানান।
উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিএম মশিউর রহমান বলেন, উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয়ভাবে আমাদের বড় অর্জনের স্মৃতিচিহ্ন `শহীদ মিনার` না থাকাটা দুঃখজনক। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলো গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। সেখানে উপজেলা সদরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়ে থাকে।
দূরত্বের কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আসা সম্ভব হয়না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফলে তাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস ও গুরুত্ব সর্ম্পকে ধারণা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার স্থাপন জরুরি বলেও মনে করেন উপজেলা প্রশাসনের এ শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত স্থান রয়েছে সে সকল প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এআরএ