বরগুনার পর্যটনখাতে অপার সম্ভাবনা, প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা
অডিও শুনুন
দক্ষিণের জেলা বরগুনায় রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে আসছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারাও। তাদের এসব উদ্যোগ একদিকে যেমন ভ্রমণপিপাসু মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে অন্যদিকে এলাকাগুলোর আর্থ-সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটছে। জেলাজুড়ে আরও সম্ভাবনাময় স্থানগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে শুধু বরগুনা নয়, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের শক্ত হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বরগুনার সমুদ্র উপকূলে রয়েছে সবুজ ম্যানগ্রোভ বন। ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে বয়ে চলা নদী-খাল প্রকৃতিকে সাজিয়েছে নান্দনিক রূপে। এরমধ্যে অন্যতম টেংরাগিরি, যেখানে রয়েছে কেওড়া, ছৈলা, গোলপাতা, সুন্দরীসহ অসংখ্য প্রজাতির গাছ। বলা হয়ে থাকে এই বনটি দেশের দ্বিতীয় সুন্দরবন। গাছগুলোর শ্বাসমূল ও বিভিন্ন লতার মেলবন্ধন যেন সুন্দরবনের নীরব প্রকৃতি থেকে কোনো অংশে কম নয়। বনে দেখা মিলবে কাঠবিড়ালির লুকোচুরি, মায়াবী চিত্রা হরিণের অবাধ বিচারণ, বানরের ছুটে চলা আর কুমিরের রোদ পোহানোর দৃশ্য।
বরগুনায় রয়েছে তিনটি স্নিগ্ধ সমুদ্রপাড়। প্রতিটি সমুদ্রপাড়ে আছে সবুজের সমারোহ। সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয়ের দেখা মিলবে এ সমুদ্রপাড়ে।
বরগুনা জেলা পর্যটন উদ্যোক্তা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফ খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কুয়াকাটায় আসা পর্যটকরা শুধু সমুদ্র দেখতে পারেন, আবার সুন্দরবন যাওয়া পর্যটকরা শুধু বন ও বন্যপ্রাণী দেখতে পারেন। তবে বরগুনায় যে সম্ভাবনা আছে তা কাজে লাগাতে পারলে বন, বন্যপ্রণী, সমুদ্র—সব একসঙ্গে দেখার সুযোগ মিলবে। তাই বরগুনার সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানো দরকার।’
বরগুনার পর্যটনের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ২০১০ সালের পর থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয় বর্তমান সরকার। ম্যানগ্রোভ বন দেখতে হরিণঘাটা বনে হাঁটার জন্য নির্মাণ করা হয় ব্রিজ, যা নির্জন বনে পর্যটকদের প্রবেশে সহায়তা করে। বনটির মধ্যে একঠি ছোট টাওয়ার করার মাধ্যমে পর্যটকদের ওপর থেকে বন দেখার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। তবে বনের শেষ প্রান্তে সমুদ্রপাড় থাকলেও সেখানে যাওয়ার জন্য রাস্তা আজও সম্পন্ন হয়নি। তাই অপ্রাপ্তি নিয়েই ফিরতে হয় সেখানে যাওয়া পর্যটকদের।
বন্যপ্রাণী দেখতে সোনাকাটার টেংরাগিরি বনে ইকোট্যুরিজম নির্মাণ করে বেষ্টনীর মধ্যে রাখা হয় বন্যপ্রাণী। তবে বেষ্টনী ভেঙে যাওয়ায় বেরিয়ে গেছে অধিকাংশ বন্যপ্রাণী। তাই বনটিতে গিয়ে প্রাণীর দেখা পেতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় পর্যটকদের। পর্যটনকেন্দ্রটির শেষ প্রান্তে সমুদ্র থাকলেও সেখানে যাওয়ার রাস্তা ও ব্রিজ ভেঙে আছে বছরের পর বছর ধরে। সংস্কার না হওয়ায় কোনো পর্যটকই সমুদ্র পর্যন্ত যেতে পারেন না।
শুভসন্ধ্যা সমুদ্রপাড়ে ছাতা ও বেঞ্চ দিয়ে সমুদ্র দেখার ব্যবস্থা করা হয় ২০১৯ সালে। রক্ষণাবেক্ষণ ও অব্যবস্থাপনায় সমুদ্রপাড়ের সে ছাতা আর বেঞ্চের এখন আর দেখা মেলে না। তাই চাইলেও কোনো পর্যটক এখন সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে পুরোপুরি তৃপ্তি পাচ্ছেন না এসব পর্যটনকেন্দ্রে।
টেংরাগিরি বনে ঘুরতে যাওয়া জাহিদ নামের এক পর্যটকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তিনি জানান, বরগুনার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে দেখার অনেক কিছু থাকলেও অব্যবস্থাপনার কারণে অদেখা থেকে যায় অনেক কিছু। স্থানগুলোতে ভোগান্তি নিয়ে ঘুরতে হয়।
তবে সুরঞ্জনা নামের পর্যটনকেন্দ্রটি ম্যানগ্রোভ বনকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ তৈরি করেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে গভীর বনে বসে কিছুটা সময় কাটানো যায়। তাই প্রতিদিনই পর্যটনকেন্দ্রটিতে হাজারো লোকের ভিড় থাকে। বিশেষ দিনগুলোতে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
সুরঞ্জনা পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরতে আসা পর্যটক ইয়াসমিন জাগো নিউজকে জানান, বরগুনায় সম্ভাবনাময় অনেক পর্যটনকেন্দ্র আছে, তবে সেগুলো উপভোগের জন্য কোনো সুব্যবস্থা নেই। তবে এসব সৌন্দর্য উপভোগের কিছুটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে সুরঞ্জনা পর্যটনকেন্দ্র।
আরেকটি বেসরকারি উদ্যোগ ‘জল তরুণী’। তারা ছোট একটি ফাইবার ট্রলার দিয়ে বনগুলোর বুক চিরে বয়ে চলা নদী-খালে পর্যটকদের ছুটে চলার ব্যবস্থা করেছে। এ ট্যুর ব্যবস্থাপনায় আছে তাঁবুঘরের মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে বনে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা।
বেসরকারি উদ্যোগ দুটি পর্যটকদের আনাগোনা বাড়িয়েছে বড়ইতলা গ্রামে। ম্যানগ্রোভ বনের পাশেই পর্যটকদের চাহিদা বিবেচনায় বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান, রেস্তোরাঁসহ গ্রামের কাঁচারাস্তাটিও এখন পাকা হয়ে গেছে।
বরগুনা জেলা পর্যটন উদ্যোক্তা কমিটির সভাপতি ও সুরঞ্জনা ইকো ট্যুরিজমের মালিক হোসেল হাফিজ জাগো নিউজকে বলেন, শুধু বন নয়, জেলার সম্ভাবনায় সবগুলো পর্যটনখাতকে পর্যটক উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলে কর্মসংস্থান হবে হাজারও মানুষের। এতে এলাকাগুলোর উন্নয়ন হবে।
বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বলেন, শুধু দুজন নয়, পর্যটনখাত উন্নয়নে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে বেসরকারি উদ্যোক্তা হিসেবে যারাই আসবেন তাদের সহযোগিতা করা হবে।
বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই অগ্রাধিকার খাতের অন্যতম পর্যটন। তাই শুধু বরগুনা নয় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন খাতে আরো গুরুত্ব বাড়ানোর তাগিদ পর্যটন সংশ্লিষ্টদের।
এসআর/এএসএম