সুজানগরে পানি প্রকল্পে ‘পুকুরচুরি’, তদন্তে স্থানীয় সরকার বিভাগ

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি পাবনা
প্রকাশিত: ০৭:৪৯ পিএম, ০১ আগস্ট ২০২২

পাবনার সুজানগর পৌরসভা এলাকায় পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন কাজে পাবনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী জামানুর রহমানের দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়েছে।

রোববার (৩১ জুলাই) তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগের তদন্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব (পাস অধিশাখা) ও পাবনার সাবেক জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা দিনব্যাপী সুজানগর পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে ওই প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির সরেজমিন তদন্ত করেন। তারা এ বিষয়ে ভুক্তভোগী স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গেও কথা বলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুজানগর পৌরসভার আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও পানি নিষ্কাশন প্রকল্পে প্রাথমিক তদন্তে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

Pabna-(2)

তদন্তের সময় পাবনা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মোখলেছুর রহমান, পাবনার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) জামানুর রহমান, সুজানগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীনুজ্জামান শাহীন, পৌরমেয়র রেজাউল করিম রেজা, সাবেক পৌরমেয়র আব্দুল ওহাব, তোফাজ্জল হোসেন তোফা, পাবনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম, পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম নবী, সুজানগর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী মামুনর রশীদ উপস্থিত ছিলেন।

সুজানগর পৌরসভা সূত্র জানায়, সুজানগর পৌরসভায় আসেনিকমুক্ত সুপেয় পানি ও নিষ্কাশন ব্যবস্থায় ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয় হলেও বিগত ৬ বছরে এর কোনো সুফল পাচ্ছেন না সুজানগর পৌরবাসী। ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পটি। বহুল আলোচিত এ প্রকল্পের মাধ্যমে সুজানগর পৌরবাসীকে আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা করা না গেলেও পাঁচজন পাম্পচালক ও একজন মেকানিকের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ২০ লাখেরও বেশি টাকা পৌরসভা থেকে গচ্ছা দিতে হচ্ছে প্রতিবছর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সুজানগর পৌরসভার আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ২০১০-১১ অর্থবছরে পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্প হাতে নেয়। এজন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় সুজানগর পৌর এলাকায় ২০০ মিলিমিটার ব্যাসের ১.১০ কিলোমিটার, ১৫০ মিলিমিটার ব্যাসের ৪.৪২ কিলোমিটার, ১০০ মিলিমিটার ২৩.৯৮ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন, উৎপাদক নলকূপ পাঁচটি, পাম্পঘর পাঁচটি, পাম্প ও মোটর ক্রয় পাঁচটি, সারফেস ড্রেন পাঁচ কিলোমিটার, ডাস্টবিন ১২টি, পাবলিক টয়লেট চারটি, তারা নলকূপ স্থাপন ৩০টি, অটো ভোল্টেজ রেগুলেটর ক্রয় পাঁচটি, দুটি কম্পিউটার ও ১৪২৫টি বাড়িতে পানির মিটার সংযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

তবে নিম্নমানের পাইপ দিয়ে পানির লাইন বসানোর কারণে পানি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ফেটে যাওয়ায় নির্মাণের পর থেকে পৌর এলাকায় পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ডিপ টিউবয়েলগুলো বসানোর পর থেকে অকেজো হয়ে আছে। পাম্পঘর নির্মাণের পর থেকে এখন পর্যন্ত চরভবানীপুর এলাকার পাম্পঘরসহ দুটি পাম্পঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলেও পাম্প ও মোটর সচল দেখানো হয়।

প্রকল্পের অন্যান্য কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে উল্লেখ করে ২০১৫ সালের জুন মাসের ২৯ তারিখের মধ্যে ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয়। এ প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে সুজানগর পৌরসভা সূত্র জানায়। বর্তমানে প্রকল্পটি পৌরবাসীর কোনো উপকারেই আসছে না বলে জানা গেছে।

Pabna-(2)

এ বিষয়ে সুজানগর পৌরসভার পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করা হয়। অভিযোগে প্রকল্পটিতে ব্যবহার করা সব পাইপ লাইনে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করার কারণে নলকূপ ও পাম্পঘর অকেজো হয়ে পড়ে আছে বলে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগের সত্যতা মেলায় ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবু নাছের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সুজানগর পৌরসভায় আসেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল করতে লিখিতভাবে নির্দেশনা দেন। তবে তিন বছর পর হলেও সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

পৌরসভা সূত্র বলছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে পৌরবাসীর আসেনিকমুক্ত সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত করা হয়নি। অথচ পাঁচজন পাম্প চালক ও একজন মেকানিকের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ২০ লক্ষাধিক টাকা পৌরসভা থেকে খরচ হচ্ছে প্রতিবছর।

পাম্প চালকেরা জানান, পাম্প চালু করার সঙ্গে সঙ্গে পাইপ ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তাই পাম্প বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় পানির পাইপ লাইন বসানো হলেও জনসাধারণের পানি সরবরাহ কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

সুজানগর পৌর এলাকার বাসিন্দা আলিম রিপন জাগো নিউজকে বলেন, তিনিসহ অনেক পৌরবাসী লিখিত আকারে তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তদন্ত কমিটির কাছে মৌখিকভাবেও অনেকে অভিযোগ করেছেন।

সুজানগর পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম রেজা বলেন, আলোচিত প্রকল্পটি চলাকালে তিনি মেয়র ছিলেন না। তবে প্রকল্পটির সুফল জনগণ পাক সেটি তিনি চান। কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করে দেওয়ার জন্য তিনি জোর দাবি জানান।

সাবেক মেয়র আলহাজ আব্দুল ওহাব ও তোফাজ্জল হোসেন তোফা জানান, প্রকল্প কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে তারা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব (পাস অধিশাখা) মো. জসিম উদ্দিন জানান, তারা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানানো হবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পাবনার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী জামানুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি এখন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।

আমিন ইসলাম জুয়েল/এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।