সিনহা হত্যার দুই বছর

প্রদীপ-লিয়াকতের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর চান টেকনাফবাসী

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কক্সবাজার
প্রকাশিত: ১২:২৫ পিএম, ৩১ জুলাই ২০২২

সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের দু’বছর পূর্ণ হলো আজ (৩১ জুলাই)। ২০২০ সালের এই দিনে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকতের গুলিতে সড়কে লুটিয়ে পড়লেও বেঁচে ছিলেন সিনহা। কিন্তু ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে এসে ফিল্মি স্টাইলে পা দিয়ে মাথা চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেন বলে সাক্ষ্যতে উঠে এসেছে।

এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে ছয় আসামিকে। সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স এখন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায়।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, বিচারিক আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৌঁছেছে রায় ঘোষণার এক সপ্তাহ পর। মামলার নথি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এরপর পেপারবুক প্রস্তুত করার জন্য সরকারি ছাপাখানায় পাঠানো হবে।’

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্র জানায়, চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স অগ্রাধিকার নাকি সালের ক্রমানুযায়ী শুনানি হবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। যদি কোনো সিদ্ধান্ত হয় তাহলে তা ডেথ রেফারেন্স শাখাকে চিঠি দিয়ে জানানো হবে। তখন ডেথ রেফারেন্স শাখা সেভাবেই মামলার পেপারবুক প্রস্তুতে পদক্ষেপ নেবে।

কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিনহা হত্যা মামলায় বাদী পক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, সিনহা হত্যাকাণ্ডের দেড় বছরের মধ্যে মামলার বিচারের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল দুই আসামি ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড দেন। যাবজ্জীবন দণ্ড দেন ছয় আসামিকে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেছেন। ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়েছে ডেথ রেফারেন্স শাখায়। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী নিম্ন আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে অধস্তন আদালতের মামলার রায়, তদন্ত প্রতিবেদন, এজাহারসহ সব নথি ডেথ রেফারেন্স আকারে হাইকোর্টে পাঠানো হয়।

সূত্রমতে, সিনহা হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পৌঁছার পর তা যাচাই-বাছাই চলছে। মামলার সব নথি ক্রমানুসারে সাজিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে পেপারবুকের জন্য। এই পেপারবুক প্রস্তুত করা হবে সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেসে। পেপারবুক প্রস্তুত হলেই মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয় এবং ডেথ রেফারেন্স ও আসামির আপিল শুনানি হয় সালের ক্রমানুযায়ী।

উচ্চ আদালতে মামলাজটের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি। বর্তমানে হাইকোর্টে ২০১৭ সালে অধস্তন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি চলছে। সে হিসাবে সালের ক্রমানুযায়ী এ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য ২০২৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বিচার প্রার্থীদের।

তবে এর আগেও শুনানি করা সম্ভব যদি রাষ্ট্র বা সুপ্রিম কোর্ট অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডেথ রেফারেন্স শুনানির উদ্যোগ নেয়। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট বা বিজি প্রেস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে। পেপারবুক প্রস্তুত হলেই অধস্তন আদালতের রায় ঘোষণার দু’বছরের মধ্যেই ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি সম্ভব বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

অপরদিকে সিনহা হত্যা মামলায় পাওয়া মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর চান টেকনাফে কারণে-অকারণে হত্যার শিকার ২০৪ ব্যক্তির পরিবার। তাদের দাবি, ওসি প্রদীপের বদ চিন্তা ও ক্ষমতার অপব্যবহারে শতাধিক শিশু এতিম হয়েছে। বিধবা হয়েছেন দুই শতাধিক নারী। কয়েকশ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। বাড়ির পুরুষ সদস্যদের ধরে এনে দিনের পর দিন থানা কম্পাউন্ডে আটকে রেখে স্ত্রী, বোন, মেয়েকে থানায় আসতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এমনও আছে চাহিদা মতো সবকিছু দেওয়ার পরও বাড়ির পুরুষ সদস্যকে বুলেট থেকে বাঁচিয়ে ফেরানো যায়নি। এমন সব পরিবারের সদস্যরা প্রদীপ লিয়াকতের ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকর হতে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করছেন।

টেকনাফ থানার দায়িত্বে থাকাকালে ওসি প্রদীপের চাঁদাবাজি, নারী ধর্ষণ, ক্রসফায়ার বাণিজ্য ও মাদক কারবারের খবরা-খবর জেনে গিয়েছিলেন মেজর সিনহা। কৌশলে এসব ভিডিও চিত্রও ধারণ করেন তিনি। এমন খবর জানতে পেরে ওসি প্রদীপ মেজর সিনহাকে কক্সবাজার ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। সেনাবাহিনীর সাহসী এ মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান তার ইউটিউব চ্যানেল ‘জাস্ট গো’ ডকুমেন্টারি নির্মাণে কক্সবাজারে অবস্থান করে নিজ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এতে মেজর সিনহাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করেন ওসি প্রদীপ, লিয়াকত ও তার সহযোগীরা।

প্রথমে ৩১ জুলাই রাতে বাহারছড়া মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিও ফুটেজ ধারণ করার সময় ডাকাত আখ্যা দিয়ে গণপিটুনিতে মেজর সিনহাকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল প্রদীপ-লিয়াকতের। এতে স্থানীয় লোকজন মেজর পরিচয় পেয়ে তাকে সম্মানজনকভাবে বিদায় দেওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরে বাহারছড়া এপিবিএন চেকপোস্টে ওসি প্রদীপ তার অধীন লিয়াকতকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে সিনহাকে। এ কারণে সাক্ষ্য প্রমাণ হওয়ায় কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতকে ফাঁসি এবং তাদের সহযোগিতা করায় অপর ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত মাত্র ৩৩ কার্যদিবসে শেষ করেছেন মামলাটির বিচারকাজ। স্বল্প সময়ে চার্জগঠন, শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি এ রায় দেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পর এ মামলা সবচেয়ে আলোচিত মন্তব্য করে সচেতন মহল বলে, এ মামলায় আদালতের দেওয়া রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়।

সায়ীদ আলমগীর/এসজে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।