‘কালোবাজারি’র টিকিট না পেয়ে রেলওয়ে কর্মচারীর তুলকালাম
অডিও শুনুন
কালোবাজারির কারণে দীর্ঘদিন ধরেই রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে সাধারণ যাত্রীদের জন্য টিকিট পাওয়া যেন সোনার হরিণ। ‘কালোবাজারি’র টিকিট না পেয়ে রাজশাহী রেলওয়ের স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘অশ্লীল’ ভাষায় গালাগাল করেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের এক কর্মচারী। এ সময় রেলওয়ের সাবেক এক কর্মকর্তাকেও উত্তেজিত হয়ে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলতে দেখা যায়।
রোববার (১৭ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টার দিকে টিকিট না পেয়ে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে অশ্লীল গালাগালের ভিডিওটি মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) রাতে প্রতিবেদকের হাতে আসে।
অশ্লীল ভাষায় গালাগালকারী রেলওয়ের ওই কর্মচারীর নাম দেবব্রত সিনহা। তিনি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আর তার সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজারসহ কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে হুমকিদাতার নাম ওয়ালী খান। তিনি রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর।
ট্রেনের টিকিট না পেয়ে দায়িত্বরত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে রেলের সাবেক ও বর্তমান এই দুই কর্মচারীর হুমকি-ধমকি ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করার ঘটনায় রেলওয়ে জিআরপি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মোমিন ওই দুজনের বিরুদ্ধে এই জিডি করেন।
অভিযোগ উঠেছে, ‘নেশাগ্রস্ত’ অবস্থায় রোববার রাতে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে যান রেলের কর্মচারী দেবব্রত সিনহা। তার সঙ্গে মহানগর শ্রমিক লীগ নেতা ও সাবেক রেল কর্মকর্তা ওয়ালী খানও যান। তারা গিয়েই কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে হইচই শুরু করেন। চাহিদামতো টিকেট না পাওয়ায় তখন চরম উত্তেজিত হয়ে দেবব্রত সিনহা রেলের দুই কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে ‘অশ্লীল’ ভাষায় গালাগাল করেন। এ সময় ওয়ালী খান টিকিট না পেয়ে জিএমকে উদ্দেশ্য করে হুমকি-ধমকি দেন এবং স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মোমিনকে তৎক্ষণাৎ স্টেশন মাস্টারের কক্ষে ডেকে নিয়ে আসতে নির্দেশ দেন।
জানতে চাইলে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মোমিন বলেন, ‘দেবব্রত সিনহা রেলের একজন কর্মচারী। কিন্তু তার অত্যাচারে আমরা বুকিং সহকারী অতিষ্ঠ। সাধারণত বুকিং সহকারীদের ডিউটি না থাকলে টিকিট কাউন্টারের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। অথচ রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী দেবব্রত প্রতিনিয়ত কাউন্টারের ভেতরে জোরপূর্বক প্রবেশ করে টিকিটের জন্য ধরনা দিয়ে আসছেন। টিকিট না দেওয়া পর্যন্ত কাউন্টারের কম্পিউটার ও সার্ভারের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো তিনি ১৬ জুলাই এসে ১৭ তারিখের যাত্রার টিকিটের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু ১৭ তারিখে জিএম স্যারসহ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা অফিসিয়াল কাজে ঢাকায় যান। যে কারণে তাকে আমি টিকিট দিতে পারিনি। এজন্য ১৭ জুলাই রাতে দেবব্রত তার কয়েকজন বাহিনী নিয়ে আমাকে খোঁজার জন্য জোরপূর্বক কাউন্টারে প্রবেশ করে কাউন্টার অফিস ঘেরাও করেন। ওইদিন দুদিনের টিকিট বিক্রির প্রায় ৬০-৭০ লাখ টাকা কাউন্টার অফিসে ছিল। যেখানে অন্য কারও কাউন্টারের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ সেখানে তিনি টিকিটের জন্য প্রতিনিয়ত জোরপূর্বক সেখানে ঢুকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন।’
‘১৭ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে আমাকে কাউন্টারের ভেতরে না পেয়ে কতর্ব্যরত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে আমিসহ রেলের আরও দু একজন কমকর্তাকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। তাই জীবনের নিরাপত্তা ও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রেলওয়ে জিআরপি থানায় জিডি করেছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও সিসি টিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ১৫ জুলাই টিকিটের জন্য দেবব্রত সিনহা তিনবার (সকালে একবার ও বিকেলে দুবার) কাউন্টার অফিসের ভেতরে প্রবেশ করেন।
প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মোমিন বলেন, ‘ওইদিন তিনি (দেবব্রত সিনহা) ১৬ তারিখের যাত্রার ধূমকেত এক্সপ্রেস ট্রেনের ৭টি এসি চেয়ার, পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনের ৪টি এসি চেয়ার, সিল্কসিটির ১টি এসি চেয়ার এবং এই তিন ট্রেন মিলিয়ে ১২টি শোভন চেয়ারের টিকিটসহ মোট ২৪টি টিকিট আমাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যান। এর আগের দিন ১৪ জুুলাই একইভাবে ২০-২৫টি টিকিট নিয়ে যান। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি একই কাজ করে আসছেন। কিন্তু ১৬ তারিখে আবার তিনি ১৭ তারিখের যাত্রার টিকিটের জন্য এলে দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় ১৭ তারিখ রাতে দায়িত্বরত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে এমন তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছেন।’
জানতে চাইলে রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর ওয়ালী খান বলেন, ‘যা সত্য তাই বলছি। সবাই টিকিট পায় আর আমরা টিকিট পাই না। কেন আমরা টিকিট পাই না তা জানার জন্যই মূলত স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়েছিলাম।’
এ বিষয়ে অভিযুক্ত পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী ও রেলওয়ে শ্রমিক লীগের যুগ্ম-সম্পাদক দেবব্রত সিনহা বলেন, ‘আমি কখনো টিকিট নেইনি। কালোবাজারির সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রমাণ করতে পারলে প্রশাসন যে শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেবো। ঘটনার দিন আমার একটা টিকিটের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমাকে না দিয়ে জমসেদ নামের একজনকে বেশকিছু টিকেট দেওয়া হয়।’
১৫ তারিখে আপনি তিনবার স্টেশন কাউন্টারের ভেতরে কেন গিয়েছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টিকেট নিতেই গিয়েছিলাম কিন্তু টিকেট দেওয়া হয়নি। মূলত রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয় করার জন্য রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান উঠেপড়ে লেগেছেন।’
পশ্চিমাঞ্চল রেলের জিএম অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘কালোবাজারির টিকিট দেওয়া বন্ধ করার কারণেই স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে ওই কর্মচারী উত্তেজিত হয়ে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেছে। আমি ঢাকায় আছি। লিখিত অভিযোগ পেলে ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সোমবার (১৮ জুলাই) রাত সাড়ে ১১টার দিকে কালোবাজারির টিকিট বিক্রির সময় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে জিয়াউর রহমান (৩৬) নামের রেলওয়ের এক কর্মচারীকে আটক করে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)। এ সময় ধূমকেতু এক্সপ্রেসের পাঁচটি কালোবাজারির টিকিটও জব্দ করা হয়। আটক কর্মচারী রাজশাহী মহানগরীর রেল কলোনি এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে এবং পশ্চিম রেলের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে বার্তাবাহক হিসেবে কর্মরত। পরে মুচলেকায় তিনি ছাড়া পান।
টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জিএম অসীম কুমার তালুকদার। তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
শুধু রেলের এই দুই কর্মচারীই নন; রেলওয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা যারা রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারাও এই টিকেট কালোবাজারির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন।
এসআর/এমএস