অব্যবস্থাপনায় ভরা ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন অব্যবস্থাপনার পরিপূর্ণ। সমস্যায় জর্জরিত এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে চরম দুর্ভোগের শিকার হন রোগীরা। রোগীর বিছানা পরিষ্কার না করায় বেড মাটির রং ধারণ করেছে। আবার বিছানার চাদর চাইলেই আনতে বলা হয় বাড়ি থেকে। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সটিও অসুস্থ। প্রায়ই নিতে হয় মেকানিকের কাছে। এমন অবস্থায় ক্ষুব্ধ হাসপাতালে আসা সেবা প্রত্যাশীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগের গেটেই ড্রেন। ড্রেন থেকে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ। বহির্বিভাগের ভেতরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষসহ প্রায় শতাধিক মানুষ। তাদের পাশে দু’চারজন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিও রয়েছেন। সংবাদকর্মী বুঝতে পেরেই সটকে পড়েন তারা। দোতলায় উঠতে গেলে সিঁড়ির নিচে দেখা যায় ময়লার স্তূপ। ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সিঁড়িতেও। ওয়ার্ডে গিয়ে বেশ কয়েকজনের বিছানায় দেখা যায়নি চাদর।
বহির্বিভাগের সামনে কথা হয় ঈশ্বরগঞ্জ পৌর শহরের ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. বজলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরে শরীরে চুলকানি, তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছে। এরমধ্যে এক প্রকার হাসপাতাল থেকেই পেয়েছি। বাকিগুলো কিনতে বলেছে।
পেটের ব্যথা নিয়ে উপজেলার ঝাটিয়া ইউনিয়ন থেকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছেন চাঁন মিয়া।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরে পেট ব্যথায় ভুগছি। গ্রামের সবাই বলেছে সরকারি হাসপাতালে গেলে টাকা ছাড়া চিকিৎসা পাওয়া যায়। ডাক্তার দেখে ওষুধ লিখে দিছে। তবে সব ওষুধ বাইরে থেকে নিতে হবে। তাহলে সরকারি হাসপাতালে এসে কী লাভ হলো?
রহিমা বেগম নামের এক বৃদ্ধা এসেছেন উপজেলার চরনিখলা থেকে। তিনি বলেন, বয়স হয়ে গেছে, এখন অনেক রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। ডায়াবেটিস, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, রক্ত পরীক্ষা ও এক্সরে করাতে হবে। ভেতরে ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও এক্সরে করার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সব পরীক্ষা বাইরে করাতে বলছে। এছাড়াও কিছু ওষুধ লিখে দিছে। সরকারি হাসপাতালে এসেছি ফ্রি চিকিৎসা নিতে। এখানে দেওয়ার মধ্যে এক পাতা ভিটামিন ট্যাবলেট ছাড়া আর কিছুই দেয়নি।
হাসপাতালের দোতলায় উঠতেই দেখা যায় সব সিট রোগীতে পরিপূর্ণ। তবে অনেকের বিছানাতেই নেই চাদর। প্রত্যেক রোগীর সঙ্গেই দুই থেকে তিনজন বাড়তি মানুষ। কেউ রোগীর বিছানায় শুয়ে, আবার অনেকে রোগীর পাশেই বসে রয়েছেন।
উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আকলিমা আক্তার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। তার বোন ফাতেমা জাগো নিউজকে বলেন, যে বিছানায় রোগী রয়েছেন তা এতো নোংরা যে কোনো মানুষ শুতে পারে না। বিছানার জন্য একটি চাদর চাইলে বাড়ি থেকে আনতে বলা হয়। ভর্তির পর হাসপাতাল থেকে দুইটা ট্যাবলেট ফ্রি দিয়েছে। ক্যানোলাসহ স্যালাইন বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের খাবারের ঠিকাদার মিন্টু জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতাল থেকে দেওয়া সিডিউল অনুযায়ী রোগীদের খাবার ও নাস্তা দিই। এর চাইতে বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
হাসপাতালের প্রধান সহকারী আব্দুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতালে অনেক কিছুরই অভাব আছে। সিকিউরিটি গার্ড সাতজন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে আছে দুজন। যে কারণে হাসপাতালের ভেতরে রোগীর মোবাইল, টাকা ইত্যাদি চুরি হয়। হাসপাতালে স্টোর রুম নেই। পুরাতন একটা অ্যাম্বুলেন্স আছে, সেটাও প্রায়ই নষ্ট হয়। পরে নিজেদের টাকায় সেটি মেরামত করতে হয়।
হাসপাতালের আরএমও ডা. সুমিত কুমার সরকার জাগো নিউজকে বলেন, বহির্বিভাগে দৈনিক প্রায় ৩০০, ইমার্জেন্সিতে ১৫০ ও হাসপাতালের ৫০ বেডে সব সময় রোগী থাকে। অনেক সময় রোগী সংকুলান করা সম্ভব হয় না।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে ২২ জন মেডিক্যাল অফিসার, শিশু বিশেষজ্ঞ একজন, মেডিসিন কনসালট্যান্ট একজন ও সার্জারি কনসালট্যান্ট একজন (নেই), পরিসংখ্যানবিদ (নেই)। রয়েছেন ফার্মাসিস্ট দুইজন, উপসহকারী মেডিকেল অফিসার দুইজন, অর্থপেডিক্স কনসালটেন্ট একজন, গাইনি একজন, কার্ডিওলজি কনসালটেন্ট একজন, চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ একজন। এছাড়াও নাইটগার্ড দুইজন, আয়া তিনজন, ওয়ার্ড বয় একজন, মালি একজন, সুইপার দুইজন কর্মরত আছেন বলেও জানান তিনি।
ডা. সুমিত বলেন, হাসপাতালে এক্সরে, ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও বিভিন্ন ধরনের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন থাকলেও সেটি অচল। ফিল্মের সংকটে বন্ধ রয়েছে এক্স'রে। তবে হাসপাতালে শিগগিরই ওটি চালু হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স বিষয়ে ডা. নুরুল হুদা বলেন, অ্যাম্বুলেন্সের জরাজীর্ণ অবস্থা। কোনো রকমে চলে। আবার রাস্তায় মাঝে মাঝে বসে যায়। প্রায় মেরামত করতে হয়, মেরামত করতে করতে আমরা ক্লান্ত। এখন মেরামতের যোগ্যতাই হারিয়ে গেছে, একটা নতুন দরকার। তাছাড়া হাসপাতালের স্টোর নেই। একটা স্টোরের প্রয়োজন। আমাদের প্রচুর যন্ত্রপাতি, ওষুধ নিয়মিত আছে, যা রাখার জায়গা নেই।
বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাতে আসা রোগীদের অভিযোগ প্যারাসিটামল ও ভিটামিন ছাড়া কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। এই বিষয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজন অনুসারেই প্যারাসিটামল ও ভিটামিন দেওয়া হয়। তবে গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিস, প্রেসারের ওষুধ দেওয়া হয়। আমরা যে ওষুধ দিচ্ছি তার একটা খতিয়ান আছে। ডায়াবেটিসের ওষুধ প্রায় শেষ। তাহলে এগুলো যাচ্ছে কোথায়, খাচ্ছে কে? পরে তিনি ওষুধ দেওয়ার তালিকা দেখান।
তিনি বলেন, আমাদের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির জনবল সংকট, পরিসংখ্যানবিদের পদ শূন্য। তাছাড়া স্টোর কিপার, এমএলএসএস পদও শূন্য। জরুরি বিভাগের অনেক পদও শূন্য আছে। নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অল্প সংখ্যক কর্মকর্তা কর্মচারী দিয়েই চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি বলেও জানান তিনি।
এফএ/এএইচ/জিকেএস