সেদিন বাঁচলেও আজও বঞ্চিত বীরাঙ্গনা ইদু মাস্টারনি
জন্ম সনদ, এনআইডি কার্ড কিছুই নেই। সে কারণেই পান না কোনো রাষ্ট্রীয় সুবিধা। অথচ দিনাজপুরের ধনি-গরিব সব শ্রেণির মানুষের কাছে একটি চেনা, জানা ও প্রিয় মুখ বীরাঙ্গনা হাসিনা বানু ওরফে ইদু মাস্টারনি (৮৫)।
মানসিক ভারসাম্যহীন এই মানুষটিকে চেনে না দিনাজপুর শহরে এমন মানুষ মেলাভার। কিন্তু কেউ বলতে পারছিলেন না তার ঠিকানা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরে শনিবার (২৫ জুন) তার ঠিকানা খুঁজে পায় জাগো নিউজ।
বীরাঙ্গনা হাসিনা বানু (৮৫) ওরফে ইদু মাস্টারনি স্বাধীনতার পর থেকে থাকেন দিনাজপুর শহরের পাক পাহাড়পুর মহল্লার ভাগিনা মনোয়ার আলী মানুর বাসায়। শনিবার বিকেলে সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় টিন ও চাটাই দিয়ে তৈরি নতুন একটি ঘরে কাঠের তৈরি চৌকিতে শয্যাশায়ী বীরাঙ্গনা হাসিনা বানু। অর্থাভাবে তার চিকিৎসাও বন্ধ।
জানা গেল, শনিবারই ঘরটি তৈরি করে দিয়েছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সেইসঙ্গে হাসিনা বানুকে চিকিৎসার জন্য নগদ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন দিনাজপুর শহর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ রায়হান শিমুল। বীরাঙ্গনা হাসিনা বানুর খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ফরহাদ রায়হান শিমুলকেই দায়িত্ব দিয়েছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
ইতোপূর্বে হাসিনা বানু ২-৩ বার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতেই থাকেন। হাসিনা বানুর এক ছেলে মাহবুব আলী ঢাকায় বসবাস করেন।
সহযোগিতার বিষয়টি জানার জন্য শহর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ রায়হান শিমুলকে ফোন করা হলে তিনি তাৎক্ষণিক ছুটে আসেন হাসিনা বানুর কাছে।
তিনি বলেন, আমরা জানতাম না যে তার জন্ম সনদ, এনআইডি কার্ড কিছুই নেই। এমনকি তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ সুবিধাও পান না। বিষয়টি মন্ত্রীকে জানিয়েছি। তিনি শনিবার পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, হাসিনা বানু যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততোদিন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী তার দেখভাল করবেন বলে জানিয়েছেন।
হাসিনা বানু ওরফে ইদু মাস্টারনির ভাগিনা মনোয়ার আলী মানু ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। করোনাকালীন সময় পুঁজি হারিয়েছেন। এখন দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে। তার পরিবারে হাসিনা বানুসহ আট সদস্য। তাদের দিন কাটে অর্ধাহার-অনাহারে।
মনোয়ার আলী মানু বলেন, আগে ঘরের স্বল্পতায় কখনো কখনো বারান্দায় থাকতেন আমার খালা। এখন মন্ত্রীর দেওয়া ঘরে থাকবেন। যে টাকা পেয়েছি সেটা দিয়ে তার ওষুধ ও খাবারের ব্যবস্থা করবো।
কে এই হাসিনা বানু ওরফে ইদু মাস্টারনি
দিনাজপুর পৌরসভায় বসবাসরত একাত্তরে সর্বস্ব হারানো এই শিক্ষিকা সবার কাছে ইদু মাস্টারনি বলে পরিচিত। তার পুরো নাম হাসিনা বানু। হাসিনা বানুর বয়স এখন ৮৫’র ঊর্ধ্বে। তিনি আর হাঁটতে বা চলাফেরা করতে পারেন না। তবে আশ্চর্যের বিষয় অসহায় ইদু মাস্টারনি কারো কাছে হাত পেতে কখনোই সাহায্য চান না। কেউ সাহায্য দিলে তিনি সেটি গ্রহণ করেন।
হাসিনা বানুর ভাগিনা মনোয়ার আলী মানু বলেন, তৎকালীন মুন্সিপাড়ায় আমার খালা বসবাস করতেন। ইদু মাস্টারনি যেন একাত্তরের বিভীষিকাকে বুকে নিয়েই সদর হাসপাতালের সামনে রোজ যেতেন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লিলি মোড়ে বসে থাকতেন। বাড়ি ফেরার পথে শহরের পাক পাহাড়পুরে শান্তির চা দোকানের পাশে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত বসে থাকতেন।
এখনও তিনি বেশিরভাগ সময়ই একা একা কখনো বাংলায় আবার কখনও ইংরেজিতে কী যেন বিড়বিড় করে বলতেই থাকেন। তবে কথা বললে তিনি একটি কথা স্পষ্টভাবেই বলেন - ‘আমার নামে আপনারা একটা দরখাস্ত লিখে দিবেন তো?’।
ইদু মাস্টারনি বা হাসিনা বানু একজন শিক্ষিত নারী। তিনি স্বাধীনতার আগে চাকরি করতেন বাংলা স্কুলে (তৎকালীন কিন্ডার গার্টেন)। সেখানে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে হাসিনা বানু দিনাজপুর সদর হাসপাতালে নার্স হিসেবে সেবা দিতেন। এ সময়ই তার জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ইদু মাস্টারনি ১৯৭১ সালে হারান তার দুই সন্তান স্বপন (১১) এবং কুপনকে (৮)।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের কোনো এক দিনে বিহারি রজাকাররা ইদু মাস্টারনিকে ধরে নিয়ে যায় খান সেনাদের কাছে। সময়টি ছিল দিনাজপুরের যুদ্ধকালীন ইতিহাসের চরমতম সময়। সবেমাত্র দিনাজপুরকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, ফলে পাকিস্তানি হায়েনারা ছিল হায়েনার চেয়েও হিংস্র এবং নিষ্ঠুর। দিনাজপুরে চলে এলাপাতাড়ি হত্যা-নির্যাতন এবং পাশবিক উল্লাস।
সেদিন ধরে আনা ইদু মাস্টারনির সঙ্গেই ছিল তার দুই শিশু সন্তান স্বপন (১১) ও কুপন (৮)। শিক্ষিত নারী হয়ে তিনি স্কুলে এবং পরে হাসপাতালে চাকরি করতেন এটাই ছিল তার অপরাধ। এছাড়া বাসায় বাসায় গিয়ে তিনি টিউশনিও করাতেন। সেসময় বাচ্চা দুটি বাধার কারণ হওয়ায় খান সেনারা তাদেরকে জোর করে ইদু মাস্টারনির বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তার চোখের সামনেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কয়েক টুকরা করে ফেলে।
ইদু মাস্টারনি তার সন্তানদের বাঁচাতে এগিয়ে এলে খান সেনারা তাকেও রাইফেলের বায়োনেট ও বাট দিয়ে মাথাসহ সমস্ত শরীরে উপর্যুপরি আঘাত করে। এতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এক সময় পাকিস্তানি হায়েনারা ইদু মাস্টারনিকে মৃত ভেবে ট্রাকে করে দিনাজপুরের বধ্যভূমি কাঞ্চন নদীর পাড়ে ফেলে দেয়।
কিন্তু জ্ঞান ফিরে অনেকটা বিবস্ত্র ও রক্তাক্ত শরীর নিয়েই ইদু মাস্টারনি হামাগুড়ি দিয়ে শেষরাতের দিকে তার পাহাড়পুরের বাসায় পৌঁছে গোঙ্গাতে থাকেন। এ সময় তার বোন তাকে ঘরে নিয়ে শরীরের জমাটবাঁধা রক্ত, বালু ও কাদা পরিষ্কার করে তাকে অতি গোপনে পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করায়। হাসপাতালে ভর্তির পর ইদু মাস্টারনির খোঁজ আর কেউ রাখেনি। পরিবারের লোকজন ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন বলে জানা যায়।
সে সময় তার স্বামী বড় সন্তান তপনকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। পরে তিনি ফিরে এলেও ছেলে তপনের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
স্বাধীনতার পর ইদু মাস্টারনি দেশে ফেরেন। এরপর তার কোলজুড়ে আসে চতুর্থ সন্তান মাহাবুব আলী। দীর্ঘ জীবনে অনেকটা সংগ্রাম করেই বেঁচে আছেন এ মহিয়সী শিক্ষক। পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনেও সেদিন হাসিনা বানু ওরফে ইদু মাস্টারনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন সত্য, কিন্তু তিনি আজ অবধি কোনো ভাতা কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো সুবিধা পাননি।
হাসিনা বানুর ভাগিনা মনোয়ার আলী মানু জানান, পৌর কাউন্সিলর ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সাহায্যের জন্য আবেদন করা হলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। অথচ যুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। তার মাথায়, কানে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত এখনো দৃশ্যমান।
স্বামী এবং সন্তানের খোঁজ
দিনাজপুর শহরের পাক পাহাড়পুর মহল্লার মরহুম মো. লালুর স্ত্রী বীরঙ্গনা হাসিনা বানু ওরফে ইদু মাস্টারনি। স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। কোথায় আছেন কেউ জানে না। আর বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তান মাহাবুব আলী ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
হাসিনা বানু ওরফে ইদু মাস্টারনির বক্তব্য
৭১’র মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের কারণে অনেকটাই মানসিক ভারসাম্যহীন তিনি। অনেক কথাই তার মনে নেই। কথা বলতে গেলে থেমে যান। যা বলেন তার অধিকাংশেরই সত্যতা মেলেনি।
তিনি বলেন, আমার তিন ছেলে আর এক মেয়ে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই ছেলে আর মেয়েকে মেরে ফেলেছে। সেই সময় চাকরি করতাম বাংলা স্কুলে (তৎকালীন কিন্ডার গার্টেন)। ওই স্কুলে সাত বছর থেকে অবসরে গেছি। সেইসময় ক্লাস নিতাম ১ম থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত। দুই শিফটে ক্লাস হতো। সকাল ৭টা থেকে ১০টা একটা এবং সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত একটা। আমি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। বেতন পেতাম ৭০ টাকা। আর যারা বি.কম পাস ছিল, তারা বেতন পেত ১১০ টাকা। পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্কুলটা বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, এখন দাঁত নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে খেতে পারি না। খাবার পেটে না গেলে কি একজন মানুষ চলে? একটা দাঁত যদি বেঁধে দেওয়া যায় তাহলে খুব ভালো হয়। দেন না, একটা দাঁত যদি বেঁধে দেওয়া যায়।
এফএ/এএইচ/এমএস