ফেরিঘাটে আর ঝরবে না মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ
২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর। শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জন ডা. মাহে আলম সকাল থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত চিকিৎসা প্রদান করেন সদর হাসপাতালে। বিকেলে জাজিরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করেন। সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। সাত্তার মাদবর মঙ্গলমাঝির ঘাটে ওইদিন সন্ধ্যায় লঞ্চ বা ট্রলার ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তিনি স্পিডবোটে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছিলেন। হঠাৎ স্পিডবোট দুর্ঘটনায় তিনি নিখোঁজ হন। দু’দিন পর নদীতে তার মরদেহ ভেসে ওঠে। এমন অনেক মানুষের প্রাণ কেড়েছে সর্বনাশা পদ্মা।
সময়ের পরিক্রমায় পদ্মা সেতুর হাত ধরে নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আজ শরীয়তপুরে উদিত হয়েছে নির্ভরতার সোনালী সূর্য। এ প্রাপ্তি শুধু রোগী ও চিকিৎসকদেরই স্বস্তি এনে দেয়নি জেলার ১৩ লাখ মানুষের মাঝে ছড়িয়েছে আনন্দের সুবাতাস।
পদ্মা-মেঘনা বেষ্টিত দুর্গম চরসহ অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে চিকিৎসা সেবায় পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি জনপদের নাম ছিল শরীয়তপুর। জেলা সদর থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ৭৩ কিলামিটার হলেও পদ্মা নদীর কারণে জরুরি রোগীকেও ঢাকায় নিতে সময় লাগত ৫-৭ ঘণ্টা। অনেক সময় ফেরির অপেক্ষায় থাকতেই মৃত্যু হয়েছে অনেক জটিল রোগীর।
তাছাড়া নদী পথের ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে অনেক ভালো মানের চিকিৎসকও এখানে আসতে চাইতেন না। এলেও বদলি হয়ে চলে যেতেন। কিন্তু গৌরবের পদ্মা সেতুর হাত ধরে সকল সংকটকে পেছনে ফেলে এখন এগিয়ে যাওয়ার পালা বলে মনে করছেন এই জেলার মানুষ।
শরীয়তপুর পৌরসভার তুলাসার গ্রামের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, করোনাকালীন সময় মুমূর্ষু অবস্থায় আমার এক আত্মীয়কে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। মাদারীপুর বাংলাবাজার ফেরিঘাট পৌঁছালে আবহাওয়া খারাপ থাকায় ঘাটে তিন ঘণ্টা দেরি করতে হয়েছে। পরে ফেরি এলেও ততক্ষণে রোগী মারা যান।
অ্যাম্বুলেন্সচালক বাবু সরদার ও মিজান মোল্লা বলেন, আগে রোগী নিয়ে ঢাকায় যেতে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা লাগতো। এখন পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকায় যেকোনো হাসপাতালে যেতে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা লাগবে। এতে করে সময় বাঁচবে এবং রোগীরাও দ্রুত চিকিৎসা পাবে।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের শিশু বিশষজ্ঞ ডা. রাজেশ মজুমদার বলেন, মুমূর্ষু অবস্থায় কোনো শিশুকে যদি ঢাকায় পাঠানো হতো তাহলে অ্যাম্বুলেন্সে করে মাদারীপুর, চাঁদপুর ও শরীয়তপুরের সাত্তার মাদবর মঙ্গলমাঝির ঘাট দিয়ে ফেরিতে পার হতে হতো। এতে সময় লাগতো ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা। পথিমধ্যে অনেক শিশু মারাও যেত। পদ্মা সেতু সেই সীমাহীন ভোগান্তি ও মৃত্যু থেকে বাঁচাবে।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সুমন কুমার পাদ্দার বলেন, শরীয়তপুরের মানুষের ঢাকায় যেতে হলে একমাত্র পথ ছিল নৌপথ। যে কারণে বিশেষজ্ঞ ও গেস্ট ডাক্তার এই জেলায় পোস্টিং নিতেন না। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো ছিল না। পদ্মা সেতু হওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। এখন বিশেষজ্ঞ ও গেস্ট ডাক্তাররা এখানে আসবেন। জেলার মানুষ উন্নত চিকিৎসা সেবা পাবে।
তিনি আরও বলেন, ২০০১ সালে সেতু না থাকার কারণে সুনামধন্য অর্থোপেডিক সার্জন ডা. মাহে আলম শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে পোস্টিং নিয়ে আসেন এবং নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দিতেন। দুঃখের বিষয় ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর পদ্মা নদী দিয়ে পরিবারের কাছে ঢাকায় যাওয়ার সময় স্পিড বোট দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়।
শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. সাইফুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এই জেলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক যেভাবে উন্নতি সাধিত হবে সেইসঙ্গে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হতে যাচ্ছে। এই জেলা থেকে অনেক অসুস্থ মুমূর্ষু রোগীকে যদি ঢাকায় পাঠানো হত এক সেতুর অভাবে অনেক রোগী পথেই মারা যেত। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অনেক সময় নদী পারাপার করা সম্ভব হত না। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শরীয়তপুরে পোস্টিং পেলেও থাকতে চাইতেন না। ফলে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতেন এই জেলার মানুষ। পদ্মা সেতুর হাত ধরে এই জেলার চিকিৎসা সেবার আমূল পরিবর্তন আমি দেখতে পাচ্ছি।
শনিবার (২৫ জুন) উদ্বোধন করা হবে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর সড়ক পথ। পরেরদিন ভোর ৬টা থেকে যানচলাচল শুরু হবে।
২০০১ সালের ৪ জুলাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের নভেম্বরে নির্মাণকাজ শুরু হয়। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এ সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে।
পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার।
পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার স্বপ্নের কাঠামো নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।
এফএ/এএসএম