পদ্মা সেতুর ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া ভাঙ্গা গোলচত্বর
পদ্মা সেতু আর ভাঙ্গা গোলচত্বর স্বপ্নের মতোই বদলে দিয়েছে ফরিদপুরের গ্রামীণ জনপদের চিত্র। এক সময় যে স্থানটি গ্রাম্য চায়ের স্টলে ঠাসা ছিল সেই স্থানটি এখন নান্দনিকতার দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ভাঙ্গা গোলচত্বর কেবল ওই অঞ্চলের সড়ক পথে চলাচলকে সহজ করেনি বরং এটি কয়েক জেলার মানুষের কাছে একটি দর্শনীয় স্থানের পরিচিতিও পেয়েছে। দৃষ্টিনন্দন এ স্থানটিতে সময় কাটাতে প্রতিদিন সকাল-বিকেলে হাজারও মানুষ ভিড় করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় নৌপথ নির্ভর জেলা ছিল ফরিদপুর। জেলার প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল কুমারগঞ্জ। পরে এটি নাম বদলে পরিচিতি পায় ভাঙ্গার হাট হিসেবে। ওই এলাকায় অত্যাধুনিক একটি ফ্লাইওভারসহ গড়ে উঠেছে ভাঙ্গা গোলচত্বর। বর্তমানে এলাকাটি দেখলে বোঝার উপায় নেই, যে এটি সেই গ্রামীণ জনপদ, যেখানে চলাচলে একসময় লেগে থাকতো কেবলই ভোগান্তি। ভাঙ্গা গোলচত্বর নির্মাণের ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট আর সরু পথে চলার সেই দুর্ভোগের অবসান হয়েছে বিস্ময়করভাবে। ঢাকার সঙ্গে পদ্মা সেতুর সংযোগে গড়ে তোলা এক্সপ্রেসওয়ের একপ্রান্ত মিশেছে ফরিদপুরের ভাঙ্গার এই গোলচত্বরে। পদ্মা সেতু থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে নয়নাভিরাম চার লেনের সুপ্রশস্ত মহাসড়ক এসে মিলিত হয়েছে এখানে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম অগ্রাধিকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের অংশ হিসেবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করা হয় ২০২০ সালের ১২ মার্চ। ২০১৬ সালের মে মাসে এর কাজ শুরু হয়। দেশের প্রথম এশিয়ান এক্সপ্রেসওয়ের অংশ হিসেবে ভাঙ্গার গোলচত্বরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি নান্দনিক ফ্লাইওভার। এর মাধ্যমে বহুপ্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা সদর হয়ে উঠবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার। পদ্মা সেতু চালুর পর ভাঙ্গা থেকে মাত্র পৌনে এক ঘণ্টায় রাজধানীতে পৌঁছানো যাবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙ্গার গোলচত্বর থেকে চার লেনের সড়ক চারদিকে চলে গেছে। মাঝে দুটি ওভারব্রিজ এবং নিচে বিস্তৃত বাইপাস ফ্লাইওভারটিকে নান্দনিক করে তুলেছে। ভাঙ্গা গোলচত্বরের ফ্লাইওভারের পশ্চিমে গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনা-বেনাপোল সড়ক, দক্ষিণে মাদারীপুর, বরিশাল হয়ে পটুয়াখালীর পায়রা সেতু হয়ে কুয়াকাটা, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, মাগুরা, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা পর্যন্ত সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। উত্তর দিকের সড়কটি ফরিদপুর জেলা সদর হয়ে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরের দিকে চলে গেছে। আর এ সড়ক দিয়েই দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি পার হয়ে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাওয়া যায়। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা যেতে সময় লাগবে ৪০-৪৫ মিনিট। যেখানে আগে সময় লাগতো পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা।
এলাকার প্রবীণরা জানান, কয়েক যুগ আগে ফরিদপুর, টেকেরহাট, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর এলাকার কুমার নদীর তীরবর্তী বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছিল কুমারগঞ্জ। প্রায় শতবছর আগে কুমার নদীর দুই পাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকা গড়ে উঠেছিল এ কুমারগঞ্জকে ঘিরে। তবে দেশ স্বাধীনের আগে হঠাৎ করেই একদিন কুমারগঞ্জের কুমার নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দাদের মাঝে হাট নিয়ে সৃষ্টি হয় বিবাদ। এরপর নদীর দক্ষিণের গঞ্জ ছেড়ে উত্তরের মানুষেরা নদীর এ পাড়ে গড়ে তোলেন নতুন একটি বাজার। এর পর থেকে সেটি লোকমুখে ভাঙ্গার হাট নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এভাবেই ভাঙ্গার নামকরণ বলে জানা গেছে।
এ ভাঙ্গা প্রথমে একটি থানা এবং পরবর্তীকালে উপজেলায় রূপ নেয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ পথে ঢাকা থেকে মাওয়া ফেরিঘাট হয়ে খুলনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী এশিয়ান হাইওয়ে নির্মিত হওয়ার পর ২০০০ সালের প্রথম দিক থেকেই ভাঙ্গা উপজেলার গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
শনিবার (২৫ জুন) উদ্বোধন হবে পদ্মা সেতু। এখন সারাদেশের নজর স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও এশিয়ান এক্সপ্রেসওয়ের দিকে। বড় দুটি প্রকল্প ঘিরে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য। পদ্মা সেতু চালুর পর ফরিদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ শুধুই যে সহজ হবে তাই নয়; একইসঙ্গে ফরিদপুরের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সূচনা হবে। পদ্মা সেতু দিয়ে ফরিদপুরে পাইপলাইনে গ্যাস সঞ্চালনের পথ সুগম হবে। ফরিদপুরে গড়ে উঠবে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা প্রতিষ্ঠান এবং ভারী শিল্প-কলকারখানা। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং এখানকার মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, যা দেশের জাতীয় আয় তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।
ফরিদপুর নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কান্তি বালা জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে ভাঙ্গার মোড় ব্যবহার করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে সরাসরি যুক্ত হবে। এতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র মোংলা, পায়রা ও বেনাপোল বন্দরের সংযোগ সৃষ্টি হবে। এই সড়ক পথের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে রেল যোগাযোগ। বর্তমানে এক্সপ্রেসওয়ের পাশ দিয়েই চলছে এই রেললাইন নির্মাণের আরেক মহাযজ্ঞ।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা বাজার বণিক সমিতির সভাপতি শহিদুল হক নিরু মুন্সি জাগো নিউজকে বলেন, একসময় এখানকার মানুষের ভরসা ছিল নৌপথ। পদ্মা সেতু চালুর ফলে সরাদেশের সঙ্গে সড়কপথেও সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। এর ফলে গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। এরই মধ্যে বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা জমি কিনতে শুরু করেছে।
ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মাসুদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ফরিদপুর একটি প্রাচীনতম জেলা। পদ্মা সেতুর কারণে উন্নয়নের নতুন দ্বার খুলে গেছে। একটি সেতুতেই বদলে গেছে ফরিদপুরের চিত্র। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। অত্র অঞ্চলের কৃষকের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে।
ফরিদপুর জেলা প্রশাসক অতুল সরকার জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর ভাঙ্গার গুরুত্ব আরও বাড়বে। অত্র অঞ্চলকে ঘিরে একটি ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার প্রস্তাব এরইমধ্যে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভাঙ্গায় পদ্মা সেতু জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া ভাঙ্গায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক মান মন্দির ও তাঁতপল্লীসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এমআরআর/এএইচ/এএসএম