স্বপ্নের সেতুতে ভোগান্তির চিরমুক্তি
ফেরি, স্পিডবোট, লঞ্চ বা ট্রলারে স্রোতস্বিনী পদ্মা পাড়ি দিতে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে শরীয়তপুরের হাজারো মানুষের। সেই ভোগান্তির হাত থেকে চিরমুক্তি দিচ্ছে গর্বের পদ্মা সেতু। আগে যেখানে ঢাকা যেতে পাঁচ-সাত ঘণ্টা সময় লাগতো, সেতু হওয়ার বদৌলতে এখন তা দু-তিন ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে। আগে বর্ষায় ছোট নৌযানকে পদ্মা যে ভয়ঙ্কর রূপ দেখাত এ পথের যাত্রীদের তা এখন সুদূর পরাহত। ২৫ জুন থেকে তা কেবলই ইতিহাস হয়ে থাকবে।
শরীয়তপুর পৌরসভার তুলাসার গ্রামের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, করোনাকালে মুমূর্ষু অবস্থায় আমার এক আত্মীয়কে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় যাচ্ছিলাম। মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাট পৌঁছালে আবহাওয়া খারাপ থাকায় ঘাটে তিন ঘণ্টা বিলম্ব করতে হয়েছে। পরে ফেরি আসলেও ততক্ষণে রোগী মারা যান। সেতুটি থাকলে তাকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলে হয়তো বেঁচে যেতেন।’
পরিবহন মালিক সাইম মোল্লা বলেন, ‘রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানভেদে শরীয়তপুরের দূরত্ব ৭৩ কিলোমিটার। এরমধ্যে ফেরি, লঞ্চ, স্পিডবোট বা ট্রলারে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় যেতে পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগতো। পোহাতে হতো দুর্ভোগ, থাকতো জীবনের ঝুঁকি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অনেক সময় নদী পারাপার হওয়া সম্ভব হতো না। এখন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে পরিবহনে ঢাকায় যেতে দুই-তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। পাশাপাশি যাত্রী ও পরিবহন চালকদের দুর্ভোগ কমবে বহুগুণ।’
শরীয়তপুর পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি ফারুক আহম্মেদ তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ জেলা থেকে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ঢাকায় যাতায়াত করেন। তাদের ফেরি, লঞ্চ, স্পিডবোটে পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অনেক সময় নদী পারাপার হওয়া যেত না। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় চরম দুর্ভোগে ছিল শরীয়তপুরবাসী। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পদ্মা সেতুর হাত ধরে শরীয়তপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে স্বপ্নিল পরিবর্তন।’
সবকিছু মিলে পদ্মা নেহায়েত একটি সেতু নয়, তার চেয়েও যেন বেশি কিছু। কারণ এ সেতু গোটা দেশের সঙ্গে শরীয়তপুর সহ দক্ষিণ বঙ্গকে এক সুতায় গেঁথে দেবে।
শনিবার (২৫ জুন) উদ্বোধন হবে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর সড়ক পথ। পরদিন ভোর ৬টা থেকে যান চলাচল শুরু হবে।
২০০১ সালের ৪ জুলাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের নভেম্বরে নির্মাণকাজ শুরু হয়। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এ সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে।
পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার।
পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার স্বপ্নের কাঠামো নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।
আরাফাত রায়হান সাকিব/এসজে
মো. ছগির হোসেন/এসজে/এএসএম