২৩ বছর ধরে আটকে আছে ফতুল্লা ইউপি নির্বাচন


প্রকাশিত: ০৪:৩৫ এএম, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

মামলা জটিলতার কারণে ২৩ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে না। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর থেকে অদ্যবধি নির্বাচন হচ্ছে না। এতে করে ইউনিয়নবাসী সকল ধরনের সুবিধাসহ নাগরিক অধিকার ভোটদান থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য নিজেদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে ১৯৯৬ সালে ইউনিয়নের পক্ষে ও বিপক্ষে হাইকোর্টে দুটি মামলা দায়ের করে। আর মামলা নিস্পত্তি না হওয়ার ফলে এখনও নির্বাচন করতে পারছে না নির্বাচন কমিশনার।

জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ ফতুল্লা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের মধ্যে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার কার্যালয়সহ নারায়ণগঞ্জ আদালত ও জেলা কারাগার রয়েছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমনকি জেলা পরিষদ, এলজিডিআর ও উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ও রয়েছে এই ইউনিয়নে।

ইউনিয়নটি ৩.৬১ র্বগমাইল আয়তনের ১০টি মৌজায় ১১টি গ্রামে লোক সংখ্যা ১,১৭,৮৩৩ জন।  এতে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান পালন, খেলাধুলা সবকিছু মিলিয়ে অত্র ইউনিয়নটি নারায়ণগঞ্জ জেলায় কালের স্বাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ফতুল্লা ইউনিয়নে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদরাসা, কিন্ডার গার্টেন এবং মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ, বৈদ্যুতিক পাওয়ার হাউস, সরকারি-বেসরকারি অফিসসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তারপরও দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে নির্বাচন থেকে বঞ্চিত রয়েছে ইউনিয়নবাসী।

এদিকে মামলা নিস্পত্তি করে ফতুল্লা ইউনিয়ন নির্বাচন করার জন্য নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও এখনো তার ফল পাওয়া যাচ্ছে না। মামলা নিস্পত্তি শেষ করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবে এমন সংবাদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে নিজেদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। বিশেষ করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন লেখা রঙিন ছবিসহ ব্যানার, ফেস্টুনের ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ইউনিয়নে। সকলেই এমপি শামীম ওসমানের সমর্থন পেতে দৌঁড়ঝাপ চালাচ্ছেন। তবে যাদের ব্যানার ফেস্টুন দেখা গেছে বেশির ভাগ চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা রাখে না বলে ইউনিয়নবাসী মনে করছে। যোগ্য কোনো প্রার্থীর এখনো নাম শোনা যাচ্ছে না।  
 
অভিযোগ উঠেছে, ১৯৯৬ সালে ফতুল্লা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান নূর হোসেন ও ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল মালেক মিলে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পর্দার আড়ালে থেকে তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে হাইকোর্টে ইউনিয়নের পক্ষে ও বিপক্ষে দুইটি মামলা দায়ের করান। এতে ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত রাখতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেন। ফলে এ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হওয়া এখনো অনিশ্চিত। তবে মামলার বাদীরা নির্বাচন চালানো নিয়ে আপত্তিসহ মামলা তুলে নেয়ার চেষ্টা করলেও বর্তমান ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান স্বপন ও ৫নং ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল মালেক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা চায় তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন না হয়।  
 
এদিকে ইউনিয়নের পক্ষে ও বিপক্ষে দায়ের করা পৃথক দুইটি রিট মামলার দুই বাদীর নাম পরিচয় এখনো অনেকেই জানেন না। আর কি কারণে ২৩ বছর যাবত ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয় না তারও কোনো খোঁজ খবর নেইনি কেউ। এতে করে চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা নির্বাচন ছাড়াই পরিষদের সকল ধরনের সুবিধা গ্রহণ করছে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে নির্বাচন না হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের তেমন কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। ইউনিয়নের জনগণ ভোটের কথা ভুলেই গেছেন। বেশির ভাগ লোকই বলতে পারছে না শেষ নির্বাচন কত সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে।  

গত কয়েকদিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ফতুল্লা ইউনিয়নের পক্ষে বিপক্ষের দায়েরকৃত মামলার দুই বাদীর নাম ঠিকানা আসল পরিচয়। তারা কাদের পরামর্শ এবং কার নির্দেশে মামলা দায়ের করেছিল তাও অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। মামলার বাদীর মধ্যে একজন হলেন ফতুল্লার কুতুবআইল (ইরান গার্মেন্ট সংলগ্ন) এলাকার মৃত হাসান আলী মাতবরের ছেলে কদর আলী মাতবর অপরজন একই এলাকার পার্শ্ববর্তী বাড়ির মৃত. সোহরাফ মাতবরের ছেলে হানিফ মাতবর। আর কদর আলী মাতবর ও হানিফ মাতবরের সঙ্গে তাদের বাড়িতে কথা হয়। এদের মধ্যে কদর আলী মাতবর ফতুল্লা ইউনিয়নকে পৌরসভা করার দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে রিট মামলা করেছিলেন। আর হানিফ ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ বহাল রাখার দাবি জানিয়ে রীট মামলা করেছিলেন।

কদর আলী মাতবর জানান, আমি কোনো রিট মামলা করিনি। নূর হোসেন চেয়ারম্যান ও আব্দুল মালেক মেম্বার আমাকে ও হানিফকে বেড়ানোর কথা বলে বাসা থেকে ডেকে গাড়িতে উঠিয়ে ঢাকা হাইকোর্টে নিয়ে যায়। ঘনিষ্টতার কারণে তাদের সব কথাই শুনতাম আমি ও হানিফ। হাইকোর্টে একজন নারী আইনজীবীর চেম্বারে নিয়ে দুইটি কাগজ বের করে দুইজনকে দিয়ে স্বাক্ষর করান। তখন আমরা দুজনেই জিজ্ঞেস করি কিসের কাগজে স্বাক্ষর করালেন। তারা আমাদের বলেছে একটি মামলা করবো। সেখানে তোমরা দুইজন সাক্ষী দিবে। পরে সব বুঝিয়ে বলবো। এরপর শুনি তারা দুজন আমাদের দুজনকে দিয়ে দুইটি মামলা করিয়েছে। ওই নারী আইনজীবীর নাম বলতে পারি না।

তিনি আরও বলেন, ২০১১ সালের ৫ অক্টোবর নূর হোসেন চেয়ারম্যানের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর ১৫ দিন পর মালেক মেম্বারকে নিয়ে আমি ও হানিফ হাইকোর্টে যায়। এরপর সেই মামলা প্রত্যাহার করে নিতে অনুরোধ করি আইনজীবীকে। এতে তিনি দুইটি কাগজে স্বাক্ষর রেখে বলেন, এটি আদালতে জমা দেয়ার পর আপনাদের মামলা প্রত্যাহার হয়ে যাবে। আর আদালতে আসতে হবে না। একই কথা বলেন হানিফ মাতবর। তার অভিযোগ, আব্দুল মালেক মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করেছেন।

এ অভিযোগ অস্বীকার করে মেম্বার আব্দুল মালেক বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান স্বপন মামলা দুটি জিইয়ে রাখছেন। তিনি চাচ্ছেন না মামলাটি প্রত্যাহার হোক। তিনি প্রতিটি তারিখে আইনজীবীর মাধ্যমে মামলাটির হাজিরা দেয়াচ্ছেন। মামলা প্রত্যাহার না হলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন।

এ অভিযোগ অস্বীকার করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান স্বপন জানান, একজন মুসলমান হিসেবে বলছি মামলা দু’টির বিষয়ে আমি কখনোই হাইকোর্টে যাইনি এবং একটি টাকাও এর পেছনে খরচ করিনি। নির্বাচন হলে আমার কোনো আপত্তি নেই। জনগণ যদি চায় তাহলে নির্বাচন করবো।

বাদী পক্ষের আইনজীবী হালিমা ফেরদৌস জানান, মামলা দুটির বিষয়ে অনেকদিন যাবত বাদীসহ কেউ আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করছে না। এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করবো না।

নারায়ণগঞ্জ জেলা নির্বাচন অফিসার তারিফুজ্জামান জানান, মামলা নিস্পত্তি ও আদালতের নির্দেশ পেলে নির্বাচন দেয়া হবে।

শাহাদাত হোসেন/এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।