বানেশ্বর হাটে ঢলনে ‘মরণ’ আম ব্যবসায়ীদের
রাজশাহী জেলার বৃহত্তম আমের হাট বানেশ্বর। এবার এই হাটে আমের জাত, স্বাদ ও আকার ভেদে আম বুঝে দাম নির্ধারিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফড়িয়া ও আড়তিরা। অপরদিকে আমচাষি ও বাগান ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ৪৬ কেজিতে মণ ধরলেও ফড়িয়া ও আড়তিরা মানছে না। ১০ থেকে ১২ কেজি আমের ঢলন ধরে আম কিনছেন তারা। এই ঢলনে মরণ এখন আমাদের।
রাজশাহী জেলার বৃহত্তম আমের হাট বানেশ্বর ঘুরে এমন তথ্য মিলেছে। বানেশ্বর আমের হাট ঘুরে ও হাট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন এ হাটে প্রায় আট থেকে দশ হাজার আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা আসেন আম বিক্রি করতে। প্রতিদিন বেচাকেনা হয় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার আম। চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় আমের মুকুল ও গুটি ঝরে পড়ায় এবার আমের ফলন কমেছে। তাছাড়া পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে আমের আকারও হয়েছে ছোট। যার কারণে আড়তদার ও ফড়িয়ারা আম বুঝে দাম হাঁকছেন।
হাটে আম বিক্রি করতে আসা চাষি ও বাগান ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্যারেট প্রতি ২ থেকে ৩ কেজি আম বাড়তি নিচ্ছেন। দুই ক্যারেটের জন্য ৫ থেকে ৬ কেজি বেশি নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আবার এক মণের বিপরীতে ঢলন হিসেবে নিচ্ছেন ৪৬ থেকে ৫০ কেজি আম। অর্থাৎ প্রায় ১২ থেকে ১৫ কেজি আম তারা বেশি নিচ্ছেন। যার কারণে আমের দাম ভালো থাকার পরও তেমন লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। হাজার কিংবা ১২০০ টাকা মণ আম বিক্রি করলেও তা ঢলন দেওয়ার কারণে আরও দু’তিনশ টাকা গচ্ছা যাচ্ছে বলে জানান হাটের আম বিক্রেতারা।
হাটের খাজনার বিষয়ে আম ব্যবসায়ীরা জানান, ক্যারেট প্রতি হাটের খাজনা দেওয়া লাগছে ৬ টাকা, মণ প্রতি ১২ টাকা। এই খাজনার টাকা যিনি আম কিনবেন তিনিই পরিশোধ করবেন।
৪৮ বছর ধরে বানেশ্বর বাজারে আমের আড়তদারি করছেন আনোয়ার। বানেশ্বর বাজার ঘুরে চষে বেড়াচ্ছেন আমের হাট। ৫০ কেজির ওপরে না হলে কেনেন না কারো আম। নগদে আম কেনেন। তাই অনেক চাষি ও ব্যবসায়ী রোদে না পুড়ে বাধ্য হয়ে তার কাছে আম বেঁচে বাড়ি ফিরছেন। সেই আম তিনি নিজের আড়তে জমাচ্ছেন।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, সবচেয়ে তিনিই বেশি পরিমাণ ঢলন নিয়ে থাকেন চাষিদের কাছে থেকে।
জানতে চাইলে এই ব্যাপারি জাগো নিউজকে বলেন, ৪৮ কেজিতে মণ করে আম কিনছি। আর ক্যারেটের জন্য ৩ কেজি করে আরও বেশি নিচ্ছি। ঢলনে আম চাষি ও ব্যবাসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন স্বীকার করেন তিনিও। কিন্তু এভাবে মাল না কিনলে পড়তা হবে না বলেও জানান তিনি।
প্রশাসনিক বিধি-নিষেধ আছে সেটির তোয়াক্কা করছেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢলন না দিলে আমরা আড়তি ও ফড়িয়ারা মাল কিনবো না। আমরা মাল না কিনলে এখানে বেচা-বিক্রিও হবে না। আমরা ব্যাপারি ও আড়তদারেরা সবাই একমত। ঢলন না দিলে কেউ মাল নেবে না, ব্যাপারিরাই আসবে না।
তিনি বলেন, এই ঢলন প্রথা আজ পর্যন্ত কেউ তুলতে পারেনি। পারবেও না। প্রশাসন এসে নিয়ম করেও এটা তুলতে পারবে না। আর এভাবে কৃষকদের তেমন ক্ষতিও হয় না বলে দাবি করেন এ আড়তদার।
বানেশ্বর বাজার এলাকার হাসু মিয়া নামের আরেক ব্যাপারি বলেন, এবার বাজারে আম কম, আবার আকারেও ছোট। তাই ব্যাপারিরা স্বাদ, সাইজ ও আম জাত বুঝে দাম দিয়ে কিনছে। তা নাহলে ব্যবসায় লাভ হবে না।
হাসুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বানেশ্বর এলাকার আমচাষি শামসুর রহমান। ৪০ ক্যারেট বড় আকারের লখনা (লক্ষণভোগ) আম নিয়ে এসেছেন বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে। ৯০০ থেকে হাজার টাকা মণ দরে বেঁচবেন আম। হাট সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি তিনি।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বারের চেয়ে এবার আমের দাম ভালো, ক্রেতাও বেশি। তবে ৫০ থেকে ৫৪তে মণ নিচ্ছেন ফড়িয়া ও আড়তিরা। এতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমরা গ্রামের বাগান থেকেই ৪০ কেজিতে মণ আম কিনছি। কিন্তু সামান্য লাভের আশায় এই হাটে এসে ১২ থেকে ১৪ কেজির ঢলন দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। প্রশাসন বা হাট ইজারাদারেরাও কিছু বলছে না। আড়তদার আর ফড়িয়ারা এক হয়ে এভাবে আমাদের জিম্মি করে মাল কিনছে।
আমের বাগান কিনে বানেশ্বর হাটে আম বিক্রি করেন শরিফুল ইসলাম। দুই ভ্যানভর্তি লখনা আম নিয়ে এসেছেন বিক্রির উদ্দেশ্যে। তবে লাভ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তিনি।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, প্রায় ৮ থেকে ১০ কেজি ঢলন নিতে চায়। আবার ক্যারেটের জন্য ২ কেজি বা তারও বেশি নেবে। এভাবে ৩০০ টাকা ম্যাইর চলে যাবে। লসেই বেচতে হচ্ছে আম।
লস করে হলেও কেন বিক্রি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশ কিছু বাগান কেনা আছে আমার। আমও পরিপক্ক হয়ে গেছে গাছে। এখন আম না বিক্রি করতে পারলে আরও বিপদে পড়ে যাবো। তাই লস হোক আর লাভ হোক সেটা না দেখে আসল টাকা ওঠানোর চিন্তায় বেঁচতে হচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি তথ্য বিভাগের উপপরিচালক মো. আব্দুলল্লাহ হিল কাফি বলেন, আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে রাজশাহীতে এবার আমের ফলন কম হয়েছে। তবে এই কম ফলনেও রাজশাহীসহ গোটা দেশের চাহিদা পূরণ সম্ভব। এবার আমের দাম বেশি হওয়ায় এই অঞ্চলের কৃষকরাও একটু লাভবান হবেন। গেল দুই বছর করোনার কারণে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা তাদের সেই ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু ঢলন প্রথায় বেশি আম ফড়িয়া বা আড়তিরা নিয়ে থাকলে তারা আবারো ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এ ব্যাপারে বানেশ্বর হাট সমিতির সভাপতি মো. সাইফুল ইসলামকে একাধিকবার তার মুঠোফোনে ফোন করেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে মন্তব্য মেলেনি।
পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ বলেন, হাট পরিচালনায় বেশকিছু দিক নির্দেশনা ও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে হাট ব্যবস্থাপনা কমিটিকে। তবে তারপরও আম চাষিদের অভিযোগ মিলছে ঢলন প্রথার মাধ্যমে চাষিদের কাছে বেশি আম নেওয়ার। এনিয়ে সতর্ক হওয়ার কথা বললেও আড়তিরা মানছে না বিধিনিষেধ। আবার ভুক্তভোগী চাষিরা সরাসরি আমাদের কাছে অভিযোগও করছে না। তাই আমরাও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছি।
এফএ/জেআইএম