১৬৮ বছরে মালনীছড়া চা বাগানের পরিধি কমেছে ১১ হাজার একর
দেশে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া বাগানে চা-চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরবর্তীতে এ বাগানের মালিকা নেন বিশিষ্ট শিল্পপতি মো. রাগীব আলী। ১৪ হাজার একর পাহাড়-টিলা নিয়ে এ চা-বাগানের যাত্রা শুরু হয়। তবে বিগত ১৬৮ বছরে এর পরিধি কমতে কমতে এখন আছে মাত্র ৩ হাজার একর ভূমি।
সিলেট এয়ারপোর্ট সড়কের পাশেই চা বাগানটির অবস্থান। সিলেটে আসা পর্যটকদের আকর্ষণে রয়েছে এ বাগান। প্রতিদিন কয়েকশ পর্যটক বাগানের মনোরম দৃশ্য দেখতে ছুটে আসেন।
ইংরেজ লর্ড হার্ডসনের হাত ধরেই এ চা-বাগানের গোড়াপত্তন হয়। সে সময় চা বাগান তৈরির জন্য ভারতের আসাম, ওড়িশা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের একই ভূ-খণ্ডের জায়গা স্থানান্তর করা হয়। ‘গাছ হিলেগা, রুপিয়া মিলেগা’ (গাছ নড়লে, টাকা মিলবে) এমন প্রলোভনে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়।
এরপর এক এক করে দেশে এখন চা বাগান আছে ১৬২টি। এর মধ্যে ১৪১টিই সিলেট বিভাগে। দেশে চা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯ লাখেরও বেশি। এরমধ্যে সিলেট জেলায় মালনীছড়াসহ আছে ২৬টি, মৌলভীবাজারে ৯২টি ও হবিগঞ্জে ২৩টি। সিলেট জেলায় চা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হবে।
সিলেট জেলায় নিবন্ধিত চা শ্রমিক আছেন প্রায় ৭ হাজার আর অনিবন্ধিত চা-শ্রমিক আছেন আরও ৭ হাজার। মোট এ ১৪ হাজার শ্রমিক দিয়ে চলছে জেলার ২৬টি চা বাগানের পাতা তোলার কাজ।
দেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়ায় এখন সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। আর জেলার অন্য চা বাগানগুলোর মধ্যে বছরে সবচেয়ে বেশি প্রায় এক মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয় মালনীছড়ায়।
২০২১ সালে এ বাগানে ৯ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদিত চা প্রতি সোমবার শ্রীমঙ্গলে নিলাম কেন্দ্রে বিক্রি হয়ে থাকে। ৩০ মে ১৯০ টাকা কেজি দরে চা-বিক্রি হয়েছে।
মালনীছড়া চা বাগানের মালিক মো. রাগীব আলী জাগো নিউজকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, দেশে সবকিছুর দাম ও খরচ বাড়লেও শুধু দাম কমেছে চা পাতার। বিগত নিলামে দাম ১৯০টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
রাগীব আলী আরও বলেন, দেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়া। ১৯৬৯ সাল থেকে এটির মালিকানায় আছি। ১৪ হাজার একর নিয়ে গঠিত মালনীছড়া চা-বাগানটির ভূমি এয়ারপোর্ট ও ক্যাডেট কলেজসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ছেড়ে দিতে দিতে এখন মাত্র ৩ হাজার একর এলাকায় বাগানটি টিকে আছে।
রাগীব আলী বলেন, ‘সরকারে অধিগ্রহণ করতে করতে আমারে তো খালি করিলিছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে ল্যান্ড ডোনার অইলাম (হলাম) আমি। আর আমারে পিঠইন মারইন হক্কইলটে। কিন্তু একথা কেউ লেখে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত বছর সাড়ে ৯ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদন হয়েছে। এবারও ফলন ভালো হয়েছে। আশা করছি এক মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হবে। এখানে প্রায় ৪ হাজার শ্রমিকও কর্মরত আছেন।’
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের (বি-৭৭) সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালাও জাগো নিউজকে বলেন, ‘চা বাগানটি আকারে এখন ছোট হলেও ব্যক্তি মালিকানায় ও সঠিক পরিচর্যার কারণে প্রতি বছর সিলেটের অন্য বাগানের মধ্যে বেশি উৎপাদন হয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেন, দেশে চা উৎপাদনের শুরু সময় শ্রমিকদের ভূমিসহ নানান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনা হলেও বাস্তবে ঘটে ভিন্ন। ভূমি তো নয়-ই, সামান্য বাসস্থানের ব্যবস্থাটাও সেসময় নিজেদের করে নিতে হয়। এরপর তাদের নিয়ে শুরু হয় পাহাড় পরিষ্কার করে চা গাছ রোপণসহ নানান কাজ।
স্বল্পমজুরি ও সব ধরনের নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত থাকায় জীবনমানের সব সূচকেই শুরু থেকে পিছিয়ে আছেন চা শ্রমিকরা। দূরদূরান্ত থেকে নিয়ে আসা শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রমে পাহাড়-টিলায় গড়ে উঠেছে চা বাগান। কিন্তু শ্রমিকরা রয়ে গেছেন বঞ্চিত-শোষিত হয়েই। এমন বঞ্চনার শিকার হয়েও শ্রমিকরা চা শিল্পকে এগিয়ে নিতে অনন্য ভূমিকা রাখছেন বলেও জানান এ চা-শ্রমিক নেতা।
ছামির মাহমুদ/এসজে/এমএস