‘মনে শুধু ভয়, কখন যেন তলিয়ে যাই’

নজরুল ইসলাম আতিক
নজরুল ইসলাম আতিক নজরুল ইসলাম আতিক , জেলা প্রতিনিধি, চাঁদপুর
প্রকাশিত: ০১:৩১ পিএম, ০১ জুন ২০২২
নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত এক মাস যাবৎ ভাঙন বেড়েছে ধনাগোদা নদীর

আব্দুল বারেক পাটওয়ারী। চাঁদপুর সদর উপজেলার ১নং বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দামোদরদী গ্রামের ধনাগোদা নদী তীরবর্তী বাসিন্দা। মাঝে মাঝেই নদীর পাড়ে বসে ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে থাকেন নদী পানে। ইতোমধ্যে দু’বার ধনাগোদার ভাঙনের শিকার হয়েছেন। এখন বসতবাড়িটি ছাড়া আর যাওয়ার কোনো যায়গা যে নেই তার। তাইতো পাড়ে বসে হয়তো নিজের তলিয়ে যাওয়া ভিটেমাটি খুঁজছেন এই বৃদ্ধ।

তার মতো প্রায় কয়েক শতাধিক পরিবারের নির্ঘুম রাত কাটে এভাবেই। কখন যেন তলিয়ে যায় তাদের একমাত্র বসত ঘর, সেই আতংক নিয়ে রাতে ঘুমাতে যান তারা। ইতোমধ্যে গত ৩ বছরে নদীগর্ভে চলে গেছে ২ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি। কেউ দুইবার কেউবা তিনবারও ভাঙনের কবলে পড়েছেন। নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে কবরস্থান, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এছাড়াও ভাঙনের মুখে আছে স্কুল, মসজিদ, মন্দিরসহ আরো কয়েক শতাধিক স্থাপনা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন অল্প অল্প করে ভাঙার কারণে বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। গত বছর ভাঙন রোধে কিছু জিও ব্যাগ নদীতে ফেললেও তারপর আর কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। এতে জনমনে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভাঙনরোধে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাব পাস হলেই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

স্থানীয়রা জানান, নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত এক মাস যাবৎ বড়দিয়া আড়ং বাজার স্ট্যান্ড থেকে দামোদরদী মিয়ার বাজার পর্যন্ত আশপাশের প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকার নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা ভাঙনের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভাঙন শুরু হয়। তাই ভাঙনরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

সরেজমিনে দামোদরদী গ্রাম ও আড়ং বাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে নদীর ভাঙনতাণ্ডব। এতে এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা ভীত হয়ে পড়েছেন। ওই এলাকার একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দামোদরদী-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আরিফ উল্লাহর বাড়ি রক্ষায় সেখানে কিছু জিও ব্যাগ ফেললেও আশপাশের আর কোথাও জিও ব্যাগ ফেলা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এতে ওইসব জায়গায় পুনরায় শুরু হয়েছে নদীভাঙন।

River-(2).jpg

স্থানীয় দামোদরদী গ্রামের বাসিন্দা মনুফা বেগম (৬০) বলেন, ‘বাবারে যেভাবেই হোক গাংডা একটু বাঁইনদা দিয়া যাও। জীবনডা একটু বাঁচায়া দিয়া যাও। আমার এই বয়সে চাইর পির (চার বার) বাড়ি ভাংচি। অহনে যদি যায় পাঁচটা অইবো। হেলে কই যামু।’

স্থানীয় দামোদরদী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল বারেক পাটওয়ারী (৬২) বলেন, ‘আমি দুইবার ভাঙনের শিকার হয়েছি। এবার যদি ভাঙে তাহলে আমার যাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না। পরিবার নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।’

স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আরিফ উল্লাহর স্ত্রী বলেন, আমার বাড়ির পাশে গত বছর জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন বন্ধ করেছে। কিন্তু ঘরের মাত্র দুই হাত দূরে নদী। এখন আমার আর রাতে ঘুম আসে না। ভয়ে থাকি কখন যেন নদীতে তলীয়ে যাই।

এছাড়াও নবী বকাউল, সামছল মিজি, সোয়েব পারীসহ অনেকেই বলেন, সারাদেশের সব জায়গায় উন্নয়ন হচ্ছে, শুধু আমাদের এখানে কেউ দেখার নেই। আমাদের মন্ত্রীকে (শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি) মনে হয় কেও বিষয়টি জানায়নি। তাই আমরা অবহেলায় আছি। মন্ত্রী জানলে অবশ্যই একটা ব্যবস্থা নিতেন।

এ বিষয়ে ১নং বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নাছির উদ্দিন খান শামীম জানান, নদীভাঙনের বিষয়ে স্থানীয় এমপি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অবগত করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার আশ্বাস দিয়েছেন তারা। গত বছর যখন ভাঙন দেখা দেয় তখন আমাদের স্থানীয় এমপি ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সঙ্গে সঙ্গে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রেফাত জামিল বলেন, বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দামোদরদী গ্রামের সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকার ভাঙন পরিদর্শন করে শনাক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে স্থায়ী ব্যবস্থার জন্য ইতোমধ্যে আমরা একটি প্রকল্প দাখিল করেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আমাদেরকে অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলেছে।

ধনাগোদার ভাঙনের কবলে রয়েছে প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার। ভাঙনের শিকার হলে নিঃস্ব হবে এসব পরিবারের প্রায় ২ হাজার মানুষ। তাই ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধানের মাধ্যমে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন নদী তীরবর্তী মানুষ।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।