গরু হৃষ্টপুষ্টকরণে ভাগ্য খুলেছে ঈশ্বরদীর খামারিদের
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অল্প সময়ে দেশি-বিদেশি জাতের গরু হৃষ্টপুষ্টকরণে ভাগ্য খুলেছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার খামারিদের। একই পদ্ধতিতে বাড়িতে তিন-চারটি গরু পালন করে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন স্থানীয় বেকার যুবকরা। ফলে অনেকে ঝুঁকছেন এ পেশায়। এ নিয়ে সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণও।
এবছরও কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হবে ঈশ্বরদীর গরু। তাই গরু মোটাতাজাকরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার খামারি ও কৃষকরা।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র জানা যায়, ঈশ্বরদীতে ২০৯৩টি বাণিজ্যিক গরুর খামার রয়েছে। এসব খামারির অধিকাংশই হৃষ্টপুষ্টকরণ বা মোটাতাজাকরণ পদ্ধতিতে গরু পালন করেন। এটি অধিক লাভবান হওয়ায় গ্রামের সাধারণ কৃষকরাও এ পদ্ধতিতে গরু পালন শুরু করেন।
সরকার গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতির নাম পাল্টে হৃষ্টপুষ্টকরণ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমেই দেশব্যাপী খামারি ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ঈশ্বরদীর ৩৫০ জন খামারি ও কৃষক এ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
আড়াই বছর থেকে চার বছরের বাছুর বা ষাঁড় হৃষ্টপুষ্টকরণ পদ্ধতিতে পালনের জন্য উপযোগী। দেশি জাতের গরু এ পদ্ধতিতে পালনে বেশি লাভবান হওয়া যায়। এছাড়া শাহীওয়াল সংকর, ফ্রিজিয়ান সংকর জাতের গরু এ পদ্ধতির জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে।
মুলাডুলি ইউনিয়নের সরইকান্দি গ্রামের হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খামারি শাহিনুল আলম বলেন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খামারিরা গরু মোটাতাজাকরণ বা হৃষ্টপুষ্টকরণে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এ বছর কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য আমার খামারে ১৬টি গরু প্রস্তুত করেছি। চারমাস আগে ১০০ বা ১১০ কেজি ওজনের এসব গরু কিনেছিলাম। এখন এগুলোর ওজন ২০০ কেজি। প্রতিটি গরু কেনা দামের চেয়ে দ্বিগুণ দামে কোরবানির হাটে বিক্রি করা যাবে।
দাশুড়িয়া ইউনিয়নের ডিগ্রি পাড়া গ্রামের গ্রামীণ এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী মহরম হোসেন বলেন, দেশি জাতের ছোট ছোট প্রায় ১০০ গরু দিয়ে খামার শুরু করছিলাম। ছয়মাসের ব্যবধানে কিছু গরু দ্বিগুণ দামে বিক্রি করেছি। আরও কিছু গরু কিনেছি। কোরবানির ঈদে এসব গরু বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছি। ন্যায্য মূল্য পেলে লাভবান হতে পারবো। ভেটেনারি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের পরামর্শ অনুযায়ী হৃষ্টপুষ্টকরণ পদ্ধতিতে গরুর খাবার দিয়ে থাকি।
সলিমপুর ইউনিয়নের চরমিরকামারী মাথালপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র খামারি নাজমুল মালিথা বলেন, গত সপ্তাহে হাটে ছয়টি দেশি গরু বিক্রি করেছি। ১০০ থেকে ১১০ কেজি ওজনের এসব গরু ৬০-৬৫ হাজার টাকা করে কিনেছিলাম। পাঁচ মাস পালনের পর প্রতিটি গরুর ১৯০ থেকে ২০০ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়েছিল । বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। খামারে আবারো ১০০ কেজি ওজনের ১২টি গরু এনেছি। এসব গরুও হৃষ্টপুষ্টকরণে পদ্ধতিতে পালন করা হবে। এ পদ্ধতিতে গরু পালন খরচ বেশি হলেও অধিক লাভবান হওয়া যায়।
চরমিরকামারী গ্রামের কিতাব প্রামানিক বলেন, ছয়মাস হয়েছে চারটি গরু কিনেছি। কোরবানির ঈদে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা যাবে। বংশ পরম্পরায় গরু পালন করে আসছি। তবে বাপ-দাদার আমলে যেভাবে গরু পালন হয়েছে এখন ওভাবে করলে লাভবান হওয়া যাবে না। তাই পশু স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শে হৃষ্টপুষ্টকরণ পদ্ধতিতে পালন করছি। ঘাস-খড়ের পাশাপাশি ভুট্টা, গম, ধানের খুড়া, খৈল, চিটাগুড় মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। পাশাপাশি স্বাস্থ্য কর্মীরা গরু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। প্রয়োজনে ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম জাতীয় ইনজেকশন দেন।
একই গ্রামের খামারি আব্দুল জলিল বলেন, দেশি গরু কিনে চার-পাঁচ পর পর বিক্রি করে দেই। যে দামে কিনে আনি তার চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করি। হৃষ্টপুষ্টকরণ পদ্ধতি ব্যবহার না করলে হয়তো এটি সম্ভব হতো না।
সলিমপুর ইউনিয়নের ভেটেনারি ভ্যাকসিনেটর ও মাঠকর্মী ইলিয়াস হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, গরু খামারে আনার পর ভেটেরিনারি চিকিৎসক দিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে কোনো রোগ ব্যাধি থাকলে চিকিৎসা করাতে হবে। এক সপ্তাহ পর গরুকে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। এরপর হৃষ্টপুষ্টকরণ পদ্ধতিতে শর্করা জাতীয় খাদ্য ভুট্টা, গম, চালের গুঁড়া, গমের ভুসি, খেসারি ভাঙানো, আমিষ জাতীয় খাদ্য সয়াবিন মিল, তিল খৈল, মিটমিল, ভিটামিন জাতীয় খাদ্য, খনিজ জাতীয় খাদ্য, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, রকসল্ট, লবণ মিশ্রণ করে গরুকে খাওয়াতে হয়। এছাড়া খামারিদের সাধ্য অনুযায়ী শাকসবজি ও কৃত্রিম ভিটামিন খাওয়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি খড়, সবুজ বা কাঁচা ঘাস এবং হজমের জন্য চিটাগুড় খাওয়াতে হয়।
গরু মোটাতাজাকরণ বা হৃষ্টপুষ্টকরণ পদ্ধতিতে গরু পালন নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা ঈশ্বরদীর স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নিউ এরা ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মোস্তাক আহমেদ কিরণ বলেন, প্রায় দুই হাজার কৃষককে মোটাতাজাকরণ পদ্ধতিতে গরু পালনের সহযোগিতা করে থাকি। আমাদের কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্যারাভেট গরু খামারি ও কৃষকদের খোঁজ রাখেন এবং পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন। এ পদ্ধতিতে গরু পালন করে খামারি ও কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।
ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. নাজমুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আধুনিক হৃষ্টপুষ্টকরণ পদ্ধতি প্রকল্পের আওতায় খামারি ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তারা সহজেই এ পদ্ধতিতে ষাঁড় জাতীয় গরু পালনে উৎসাহিত হচ্ছেন। অল্প সময়ে অধিক লাভের পাশাপাশি দেশের মাংসের চাহিদা পূরণেও এ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এসজে/এএসএম