যে মঠের ইটের ফাঁকে লুকিয়ে আছে জ্ঞানদা সুন্দরীর করুণ গাঁথা
অডিও শুনুন
ইংরেজ শাসনামলে আইন করে বন্ধ করা হয় স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে একসঙ্গে পুড়িয়ে হত্যা বা সতীদাহ প্রথা। কিন্তু এরপরও জঘন্য সতীদাহের বলি হতে হয়েছিল কিশোরগঞ্জের জ্ঞানদা সুন্দরীকে। তারই স্মৃতিস্বরূপ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষে সতীদাহের বলি জ্ঞানদা সুন্দরীর সহমরণ মঠ। বর্তমানে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে মঠটি। হেলে একপাশ ভেঙে গেছে। মঠটি সংস্কার করে সংরক্ষণের দাবি এলাকাবাসীর।
জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার গুজাদিয়া রামনগর গ্রামে মৃতপ্রায় নরসুন্দা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে জরাজীর্ণ আর লতাপাতায় ঘেরা জ্ঞানদা সুন্দরীর সহমরণ মঠ। প্রায় দু’শ বছরের পুরনো এ মঠের ভাঙা ইটের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে ধর্মীয় কুসংস্কারে জ্ঞানদা সুন্দরীর আত্মাহুতির করুণ গাঁথা। সে সময়কার হিন্দু রক্ষণশীল পরিবারের ভয়ংকর কুসংস্কার আর বর্বরতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয় এ মঠ।
জানা গেছে, ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিকের শাসনামলে রাজা রামমোহন রায়ের তীব্র আন্দোলনের মুখে ভারতবর্ষে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় সতীদাহ প্রথা বা সহমরণ। তবে এরপরও বিভিন্ন এলাকায় চলছিল জঘন্য এ বর্বরতা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা ১২৩৪ সালের ২৬ বৈশাখ রামনগর গ্রামের জমিদার বাড়ির এক কর্মচারীর মৃত্যু হলে তার স্ত্রী জ্ঞানদা সুন্দরীকেও স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতিতে বাধ্য করা হয়। এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হলে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত।
জ্ঞানদার ছেলে গয়ারাম চক্রবর্তীকে ৬ মাসের জেল দেন আদালত। পরে গয়ারাম অনুতপ্ত হয়ে মায়ের স্মৃতি রক্ষায় চিতাস্থলে নির্মাণ করেন একটি মঠ।
ঐতিহাসিক এ মঠটি হেলে পড়েছে। ভেঙে গেছে মাঝখানের একটি অংশ। লতাপাতা আঁকড়ে ধরেছে সু-উচ্চ মঠের চারপাশ। যেকোনো সময় এটি ভেঙে পড়তে পারে। সতির মঠ হিসেবে পরিচিত জ্ঞানদা সুন্দরী সহমরণ মঠের ৫ শতাংশ জমি এরইমধ্যে বেদখল হয়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
মধ্যযুগে হিন্দু রক্ষণশীলদের কুসংস্কার আর অমানবিক ঘটনা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এটি সংস্কার ও সংরক্ষণ জরুরি বলে মনে করেন বিজ্ঞজনেরা।
রাগনগর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক সুজিত কুমার সরকার জানান, এ মঠটি ইতিহাসের বর্বরোচিত ঘটনাকে বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। এটি যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। এ যুগের মানুষকে সেই নিষ্ঠুর কাহিনী জানানোর জন্য মঠটি সংস্কার করা প্রয়োজন।
করিমগঞ্জের লোক সংগ্রাহক নজির আহমেদ বলেন, ‘এক সময় আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে এমন কুসংস্কার ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে চিতায় পুড়িয়ে মারা হতো। এটি ছিল খুবই জঘন্য রীতি। আইন করে সতীদাহ বন্ধ করার পরও অনেক স্থানে গোপনে এমন অপকর্ম চলতো। জ্ঞানদা তাদেরই একজন। অনিচ্ছা সত্তেও যাকে হাত-পা বেঁধে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ মঠটি অবশ্যই সংস্কার করা প্রয়োজন।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় মঠটি সংস্কার ও সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান করিমগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নাসিরুল ইসলাম আওলাদ।
এফএ/জেআইএম